আইন-আদালতচট্টগ্রাম

আরও ২টি অর্থঋণ আদালত হচ্ছে চট্টগ্রামে

খেলাপি ঋণ আদায়ে চট্টগ্রামে আরও দুটি অর্থঋণ আদালত গঠন করা হবে। আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে এরইমধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

প্রতিটি আদালতের জন্য একজন করে যুগ্ম জেলা জজ ও পাঁচজন সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ অনুমোদন করা হয়েছে।

গত বছর চট্টগ্রামে চারটি নতুন অর্থঋণ আদালত গঠনে নির্ধারিত পদ সৃজনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়।

ওই প্রস্তাব পর্যালোচনা শেষে সম্প্রতি ঢাকায় ৩টি ও চট্টগ্রামে ২টি নতুন অর্থঋণ আদালত গঠনের বিষয়ে ৩০টি পদ সৃজন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে।

প্রস্তাবিত পদের মধ্যে রয়েছে- যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারক, প্রতিটি আদালতের জন্য একজন করে সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর, বেঞ্চ সহকারী, ড্রাইভার, জারিকারক ও অফিস সহায়ক। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন শেষে ফাইলটি সচিব কমিটিতে পাঠানো হবে। সেখানে অনুমোদনের পর ফাইলটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অনুমোদনের জন্য যাবে। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয় ৩০টি পদের বেতন স্কেল নির্ধারণসহ পৃষ্ঠা অঙ্কন করবে। পরে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হবে। আশা করা হচ্ছে, দুই-তিন মাসের মধ্যে প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন হবে। এই আদালতগুলো গঠন করা হলে খেলাপি ঋণ আদায়-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে গতি বাড়বে।

চট্টগ্রামে অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে মাত্র একটি অর্থঋণ আদালত রয়েছে। সেখানে প্রায় পাঁচ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এখন গড়ে দুই থেকে তিনটি মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে প্রতিদিন। ২০২২ ও ২০২৩ সালের ২৪ মাস ও চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে মামলা দায়ের হয়েছে ৪ হাজার ২২০টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ হাজার ৮১৯টি। ১০ বছরের অধিক পুরনো মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে ১৭৭টি।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে মামলা দায়ের হয়েছে ৩৯১টি। তারমধ্যে অর্থ ঋণ মামলা ২০৮টি, জারি ১৬৭টি ও মিস মামলা ১৬টি। চার মাসে নিষ্পত্তি করা হয় ৪১৬টি মামলা, যার মধ্যে ১০ বছরের অধিক পুরনো মামলা ছিল ১৭টি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে অর্থঋণ মামলা ২৯২, জারি মামলা ১১৫ ও মিস মামলা ৯টি।

এরআগে ২০২৩ সালে মামলা দায়ের হয়েছে ২ হাজার ২৭১টি। এরমধ্যে অর্থঋণ মামলা ৭৮৭টি, জারি ১৩৯৯টি ও মিস মামলা ৮৫টি। ওই বছর নিষ্পত্তি করা হয় ১৬৮০টি মামলা, যার মধ্যে ১০ বছরের অধিক পুরনো মামলা ছিল ৯২টি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে অর্থঋণ মামলা ১৩৫৫, জারি মামলা ২৫১ ও মিস মামলা ৭৪টি। ওই বছর অর্থঋণ মামলা বাবদ আদায় করা হয়েছে ৬শ কোটি টাকা।

২০২২ সালে মামলা দায়ের হয়েছে ১ হাজার ৫৫৮টি। এরমধ্যে অর্থ ঋণ মামলা ৯১৭টি, জারি ৫৫১টি ও মিস মামলা ৯০টি। ওই বছর নিষ্পত্তি করা হয় ১৭২৩টি মামলা, যার মধ্যে ১০ বছরের অধিক পুরনো মামলা ছিল ৬৮টি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে অর্থঋণ মামলা ১২৮৩, জারি মামলা ৩০৫ ও মিস মামলা ১৩৫টি। ওই বছর অর্থঋণ মামলা বাবদ আদায় করা হয়েছে ৯শ কোটি টাকা।

২০২১ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে ১২৩৪টি। এরমধ্যে অর্থ ঋণ মামলা ৯০৫টি, জারি ২৬৯টি ও মিস মামলা ৬০টি। ওই বছর নিষ্পত্তি করা হয় ৭৯৯টি মামলা, যার মধ্যে ১০ বছরের অধিক পুরনো মামলা ছিল ৩৬টি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে, অর্থঋণ মামলা ৫১৯, জারি মামলা ২৩০ ও মিস মামলা ৫০টি। ওই বছর আদায় করা হয়েছে অর্থঋণ মামলা বাবদ প্রায় ৬শ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির পেছনে বিচারক মুজাহিদুর রহমানের ভূমিকাই বেশি বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তারা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে তিনি এই আদালতের বিচারক হিসেবে যোগদান করার পর আদালতের মামলাজট কমিয়ে আনতে বেশ কিছু সাহসী উদ্যোগ নেন। এতে গ্রেপ্তারের ভয়ে অনেক ঋণখেলাপি মামলা নিষ্পত্তিতে এগিয়ে আসেন। এ ছাড়া যেসব মামলায় বন্ধকি সম্পত্তি আছে, সেগুলোতে রিসিভার নিয়োগ করেন।

রিসিভার নিয়োগ করলে বন্ধকি সম্পত্তিতে ঋণখেলাপিরা তাদের কর্তৃত্ব হারায়। যে কারণে তারা দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে এগিয়ে আসেন। অন্যদিকে তিনি দেখেছেন, যেসব ঋণের বিপরীতে কোনো সম্পত্তি বন্ধক থাকে না, সেক্ষেত্রে বিবাদীরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি ওইসব ঋণখেলাপির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। এ ছাড়া আইনের বিধান মোতাবেক বিবাদীদের প্রতি নেজারত সমন এবং পত্রিকার মাধ্যমে সমন জারি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন। যে কারণে বর্তমানে আদালতে পাঁচ মাস বয়সি কোনো মামলা সমন জারি পর্যায়ে আটকে নেই। মূলত এসব কারণেই আদালতে মামলা নিষ্পত্তি বেড়েছে।

অর্থঋণ আদালতের আইনজীবী আলী আজগর চৌধুরী বলেন, মামলার জট কমিয়ে আনার বিষয়ে বিচারকের ভূমিকাই মুখ্য। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুত সমন জারি করেছেন। আসামিরা যতই প্রভাবশালী হোক, ছাড় দেননি। বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। অনেকে এখন কারাগারে রয়েছেন। অনেক আসামির বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এ কারণে ঋণখেলাপিরা ভয়ে মামলা নিষ্পত্তিতে এগিয়ে আসছেন।

চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আসিফ ইশতিয়াক চৌধুরী বলেন, অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি করার সর্বোচ্চ সময়সীমা হচ্ছে ১২০ দিন। অর্থঋণ আদালত আইন হয়েছিল, দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হবে, সেটি কিন্তু পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। যথাসময়ে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না কিংবা ঋণের অর্থ দ্রুততম সময়ে আদায়ও হচ্ছে না।

সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সরকার তৎপর। এ লক্ষ্যে ঢাকায় ৩টি ও চট্টগ্রামে ২টি নতুন অর্থঋণ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d