চট্টগ্রামস্বাস্থ্য

এখনও আইসিইউ’র জন্য হাহাকার

আক্তার বেগম মনি। হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতায় ভোগা ৪২ বছর বয়সী এ নারী। শারীরিক অবস্থা মুমূর্ষু হওয়ায় তাঁকে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) ভর্তি করাতে বলেন চিকিৎসকরা। এজন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে যোগাযোগ করেন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু দু’সপ্তাহ কেটে গেলেও খালি না থাকায় এখন পর্যন্ত সরকারি এ হাসপাতালে মেলেনি একটি আইসিইউ শয্যা। বারবার যোগাযোগ করেও শয্যা মেলেনি হাসপাতালটিতে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়- শুধু আক্তার বেগমের অপেক্ষাই নয়। হাসপাতালটির ২০ শয্যার আইসিইউ বিভাগে প্রতিদিনই অন্য হাসপাতাল থেকে গড়ে পাঁচ জনের অধিক রোগী শয্যা পেতে আবেদন করে থাকেন। এছাড়াও হাসপাতালে অভ্যন্তরীণ মুমূর্ষু রোগীদেরও আইসিইউ’র জন্য অপেক্ষার সারি দীর্ঘ থাকে প্রতিদিন। কিন্তু শয্যা-সংকটে সবার ভাগ্যে জোটে না শয্যা। যার কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন অনেকেই।

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, ‘শয্যার অভাবে হাসপাতালে ভর্তি থাকা অনেক মুমূর্ষু রোগীকে সঠিক সময়ে আইসিইউতে রাখা যায় না। তারমধ্যে বাইরের হাসপাতাল থেকেও প্রতিদিনই ৫ জনের বেশি আবেদন আসে। চমেক হাসপাতালে ২০ শয্যা থাকলেও বরিশাল, দিনাজপুরসহ কিছু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ৭০টি। অথচ ঢাকার পরে অবস্থান হচ্ছে চট্টগ্রাম। এ হাসপাতালে কম পক্ষে দু’শ আইসিইউ থাকার প্রয়োজন। যদিও ইতোমধ্যে ১২০ শয্যার আইসিইউতে উন্নিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আশা করছি শীঘ্রই চমেক হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা উন্নিত হবে।’

তথ্য অনুযায়ী, চমেক হাসপাতালে ২০ শয্যার, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১০ শয্যা, ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতালে ৫ শয্যা এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোসহ সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে শয্যা রয়েছে সর্বোচ্চ দেড়শ’।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড মহামারির আগে চট্টগ্রামে আইসিইউ শয্যার সংখ্যা ছিল শতকের নিচে। কিন্তু শয্যার সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও কোভিডকালের মতোই হাহাকার যায়নি। সংকটাপন্ন রোগীকে নিয়ে স্বজনেরা ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে। কিছু ক্ষেত্রে আইসিইউর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে রোগীর মৃত্যুও হচ্ছে। যে চিত্র করোনাকালে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এরপরও উন্নিত হয়নি এ সেক্টরে।

চট্টগ্রামের ৩ কোটি মানুষের জন্য অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট মাত্র দেড়শ’ জন!

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন ফিজিশিয়ানসের (বিএসএ-সিসিপিপি) তথ্যমতে, যেকোনো উন্নত দেশে এক লাখ মানুষের জন্য অন্ততপক্ষে ২০ জন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট থাকেন। উন্নয়নশীল দেশে এ সংখ্যা ৫ থেকে ১০ জন হয়। সে হিসেবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৩ কোটি মানুষের জন্য কমপক্ষে দেড় হাজার অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট বা অবেদনবিদ থাকার কথা। কিন্তু সোসাইটির তথ্য অনুসারে- এ সংখ্যা মাত্র দেড়শ’ জন। যদিও চিকিৎসকদের ধারণা- সব মিলিয়ে দু’শ জন অবেদনবিদ রয়েছেন বৃহত্তর চট্টগ্রামে।

চিকিৎসকরা বলছেন- যেকোনো অস্ত্রোপচারে একজন অবেদনবিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর করোনাকাল অবেদনবিদের এই সংকট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ আইসিইউ ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত অবেদনবিদ না থাকলে রোগীদের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অবেদনবিদের সংখ্যা অপ্রতুল।

বিএসএ-সিসিপিপি চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ হচ্ছে অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগ। কিন্তু অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের যে পরিশ্রম, সে অনুযায়ী সম্মানি নেই। এ কারণে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এ সেক্টরের প্রতি অনীহা। অথচ এক সময়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই এ সাবজেক্টে পড়াশোনা করতে বেশি আগ্রহী ছিল।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশীদ বলেন, ‘কোভিডকালে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের কী পরিমাণ ভূমিকা ছিল, তা সবাই দেখেছে। সাধারণত অস্ত্রোপচার, আইসিইউ ও পেইন ম্যানেজমেন্ট করতে সবার চেয়ে ভূমিকাটা বেশিই ছিল তাঁদের। মুমূর্ষু রোগীর ইনটেনসিভ কেয়ার, জটিল ব্যথার চিকিৎসা, বিভিন্ন রোগীর পেলিয়েটিভ কেয়ার সেবা প্রদানসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা। কিন্তু চাহিদা থাকার পরও পর্যাপ্ত চিকিৎসক গড়ে ওঠছে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d