কালবৈশাখীতে লন্ডভন্ড চট্টগ্রাম, অন্তহীন ভোগান্তি
টানা দেড় ঘন্টার বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম শহরে তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। রাস্তা-ঘাট পানিতে তলিয়ে গিয়ে কোথাও হয়েছে কোমর ও কোথাও হাঁটু পানি। দেখা দিয়েছে যানজট। এতে অন্তহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। এছাড়া প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ায় গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকার অফিস, দোকান ও বাড়িঘর। এমনকি বন্ধ হয়েছে মহাসড়কের যান চলাচলও।
সোমাবার (৬ মে) সকাল থেকে চট্টগ্রাম ও আশেপাশের উপজেলায় প্রচণ্ড গরম অনুভূত হয়। রোদের তীব্র খরতাপে পুড়ছিল মানুষ। কিন্তু দুপুরের পর থেকে আকাশ মেঘলা হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ঘন অন্ধকার নেমে আসে শহরের আকাশে। একপর্যায়ে শুরু হয় হালকা বাতাস। ক্রমেই সেই বাতাস বাড়তে থাকে। এরপর শুরু হয় প্রবল বর্ষণ ও বজ্রপাত। সেই সাতে শোঁ শোঁ বাতাস। মুহুর্তেই জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। কেউ কেউ দৌঁড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন কারও দোকান বা বাড়ির ছাউনির নিচে। ব্যবসায়ীরা দোকানের সাটার নামিয়ে ভেতরে অবস্থান করেন। বিশেষ করে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন বাইরে থেকে শহরে আসা মানুষজন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা।
শুধু তাই নয় ঝড়, বৃষ্টিতে সড়কে পানি জমে গেলে নগরের বিভিন্ন এলাকায় যানজট দেখা দেয়। তবে প্রচণ্ড গরমের পর স্বস্তির বৃষ্টি নামায় অনেকেই উল্লাসে ফেটে পড়েন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরে টানা দেড় ঘন্টার বৃষ্টিতে নগরের জিইসি মোড়, ২ নম্বর গেইট, আলফালাহ গলি, শেরশাহ, টেক্সটটাইল, রুবি গেইট, রহমান নগর, ওয়াসা মোড়, লালখান বাজারের মতিঝর্ণা, মুরাদপুর, চকবাজারের বাদুরতলা, জঙ্গিশাহ মাজারসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তা পানিতে ডুবে যায়। লালখান বাজার, ডিসি হিল, আমবাগানসহ পাহাড়ের পাশের এলাকাগুলোতে ঢল নামে। আরও ডুবে গেছে নগরের আগ্রাবাদ, চৌমুহনী, কমার্স কলেজ রোড়সহ আশেপাশের এলাকা। নগরের খালগুলো পানিতে টুইটুম্বুর হয়ে যায়। বায়েজিদ ফৌজদারহাট লিংক রোড়ে পাহাড় ধ্বসে সড়কে পড়েছে। সাময়িকভাবে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে ডুবে যাওয়া এলাকা থেকে দ্রুত পানি নেমে পড়বে বলে আশা করছেন নগরবাসী।
ফটিকছড়ি থেকে নগরের মুরাদপুরে এসে বিপাকে পড়েছেন মো. শফি। তিনি বলেন, মুরাদপুরে একেবারে হাঁটু পানি জমে গেছে। কিছুতেই নড়তে পারছিনা। কখন ফিরতে পারব তা নিয়ে শঙ্কায় আছি।
মো. আরাফাত এলাহী বলেন, আন্দরকিল্লায় এসে ঝড়ের কবলে পড়ি। এরপর একটি দোকানে দুই ঘন্টার জন্য আটকে গেলাম। প্রচণ্ড বজ্রপাতে ভয় পেয়েছিলাম।
মুরাদপুরে মোহাম্মদ পারভেজ বলেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বাসা রিক্সা নিয়ে বের হয়েছি। কিন্তু মুরাদপুরের কাছে এসেই বিপত্তি বাধে সড়কের পানি। পানিতে থৈ থৈ মুরাদপুর। বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটেই যেতে হচ্ছে।
বহদ্দারহাট সংলগ্ন এশিয়ান হাউজিং সোসাইটির সেক্রেটারি খোরশেদ আলম বলেন, আমাদের আবাসিক এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সবাই এখন ঘরবন্দি। ড্রেন থেকে কালো ময়লা পানি বের হচ্ছে। এসব পানি ভবনের নিচ তলা হয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। যা অত্যন্ত অসহ্যকর।
দুই নম্বর গেইটের বাসিন্দা খাদ্যপণ্যের ব্যবসায়ী রেজাউল করিম রাজু বলেন, বিকালে দোকান খোলার জন্য ঘর থেকে বের হচ্ছিলাম। সেই মুহূর্তে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। মাত্র দেড় ঘন্টার বৃষ্টিতে হাঁটু পানি জমে গেছে। এখন বের হতে পারছি না। আজ মারাত্মক লোকসানে পড়তে হলো।
নগরের শপিং সেন্টারের পাশে গাছ ভেঙে পড়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। খুলশির জাকির হোসেন রোডে বিদ্যুতের খুঁটির ট্রান্সফরমার ভেঙে পড়েছে। চকবাজার এলাকার বৌদ্ধ মন্দির, পাসপোর্ট অফিস, সিডি রোড এলাকায় ঘরে বস্তি ঘরে প্রবেশ করেছে পানি। সোমবার সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে চট্টগ্রাম নগরের নির্মাঞ্চলের বাসিন্দাদের উপর দুর্ভোগ নেমে আসে।
এদিকে কেবল চট্টগ্রাম নগর নয় প্রবল বর্ষণ আর কালবৈশাখীতে বিপর্যস্ত হয়েছে জেলার বিভিন্ন উপজেলার জনজীবন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার মিরসরাইয়ে গাছ পড়ে উপজেলা ভূমি অফিসের ভবন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গাছপালা পড়ে মানুষের বাড়িঘরের ছাল উড়ে গেছে। কারো কারো দোকান, অফিস ভেঙে গেছে। সীতাকুণ্ড উপজেলার পৌর এলাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বড় বড় গাছ উপড়ে পড়েছে। এতে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল।
ফটিকছড়ি সুয়াবিল হাজারীখিল এলাকায় গাছ পড়ে কয়েকটি বসত ঘর ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে। পটিয়া, আনোয়ারা, কর্ণফুলী, বাঁশখালীতে তীব্র কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে। টানা দেড় ঘন্টার ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছে বাড়িঘরসহ বহু স্থাপনা।
কালবৈশাখীর ঝড়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কেও যান চলাচল বন্ধ থাকে কিছু সময়। পরে মহাসড়কের একপাশ বন্ধ হয়ে থেমে থেমে যানবাহন চলাচল করায় যানজটের সৃষ্টি হয়। কোথাও কোথাও যান চলাচল দুই পাশেই বন্ধ হয়ে যায়। জেলার পটিয়ায় মহাসড়কের আমজুরহাট, কমলমুন্সির হাট, বাইপাস ও চন্দনাইশের কাঞ্চননগরসহ আশেপাশের এলাকায় যানজট দেখা দেয়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লে. কর্ণেল মো. ফেরদৌস আহমেদ বলেন, যে পরিমাণ পানি নগরে জমেছে সেগুলো আবার নেমে গেছে। নগরের খালগুলোতে থাকা বাঁধগুলো আমরা সরিয়ে দিয়েছি। যেন দ্রুত পানি নেমে যেতে পারে। খালগুলো যেন প্রবাহমান থাকে। এছাড়াও কোথাও পানি জমে আছে কিনা সেটি দেখতে মাঠে আমাদের টীম কাজ করছে।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের এসিসটেন্ট মেটোলজিস্ট মেঘনাথ তঞ্চ্যঙ্গা বলেন, গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে আজ সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে চট্টগ্রামে।