চট্টগ্রাম

কালুরঘাটে সেতু : নতুন মন্ত্রীর পুরনো বয়ানে নতুন হতাশা

বুধবার চট্টগ্রামে প্রথম সফরে এলেন নতুন রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম। দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি, কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণ করা নিয়ে নতুন মন্ত্রীর মুখে নতুন বার্তা পাবেন— এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু মন্ত্রীর কাছ থেকে নতুন কিছু শোনা যায়নি। উল্টো, তিনি যে বয়ান দিয়েছেন তাতে ভীষণ বেজার সবাই। তবে ‘বার্ধক্যের রোগ’ সারিয়ে মার্চের মাঝামাঝি পুরনো সেতুতে গাড়ি চালুর সুখবর দিয়েছেন মন্ত্রী।

রেলমন্ত্রী বলেছেন, ‘কালুরঘাট নতুন সেতু হতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগবে। আমাদের সমীক্ষা শেষ। কোরিয়ান অর্থায়নে নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণ করা হবে।’

নতুন মন্ত্রীর মুখে আবারও সেই পুরনো বার্তা পেয়ে যারপরনাই হতাশ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরাও। তারা বলছেন, সমীক্ষা শেষ, চার-পাঁচ বছর সময় লাগবে পুরনো মন্ত্রী-জনপ্রতিনিধিরা এসব ‘গীত’ গেয়ে গেছেন বহুবার। মন্ত্রীর চেয়ারে বসে চট্টগ্রামের মাটিতে প্রথম পা দিয়েছেন রেলমন্ত্রী। সেটিকে উপলক্ষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণের দাবি কালুরঘাট সেতু নির্মাণের বিষয়ে নতুন বার্তা দিতে পারতেন তিনি। কেউ বলেছেন, নতুন সেতু নির্মাণে কত সময় লাগতে পারে তাঁর ধারণা সবার আছে। কাজ কবে শুরু হবে বলতে না পারলেও মন্ত্রী হিসেবে কাজ এগিয়ে নিতে তাঁর কেমন ভূমিকা থাকবে তা তিনি বলতে পারতেন। এতে কিছুটা হলেও নতুন সেতুর ব্যথা প্রশমিত হতো। কেউবা নতুন জনপ্রতিনিধির দিকে আঙুল তুলেছেন। তারা বলছেন, বোয়ালখালীবাসীর ‘গায়ের ঘা’ নতুন মন্ত্রীকে দেখানো উচিত ছিল। এপার-ওপারে চলাচলের চিত্র দেখলে হয়তো মন্ত্রী কিছুটা হলেও ব্যথা ‘ঠাউর’ করতে পারতেন।

এদিকে বোয়ালখালী-চান্দগাঁও (চট্টগ্রাম-৮) আসনের নতুন সংসদ সদস্য হওয়া আবদুচ ছালাম মনে করেন, সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়াটাই আসল ব্যাপার। সময় কতদিন লাগবে সেটি নয়।

তবে নতুন সেতু নিয়ে নতুন রেলমন্ত্রীর আন্তরিকতার কথা জানিয়ে আশার বার্তা দিয়েছেন ছালাম। সিভয়েস২৪-কে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী কথা দিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব এটা একনেকে পাঠানো হবে। একনেক থেকে পাস হয়ে কাজ শুরু করার প্রক্রিয়া চলবে।’

বোয়ালখালী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এস. এম. সেলিম বলেন, ‘দীর্ঘদিনের এ কালুরঘাট সেতু নিয়ে আমরা মনে করেছিলাম— নতুন সরকার গঠন হয়েছে; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু-এক বছরের মধ্যে নতুন সেতু করে দিবেন। কিন্তু উনার (রেলমন্ত্রী) বক্তব্য আমাদের আরও পিছনের দিকে নিয়ে গেল। এখন সম্ভাবনার চেয়ে অসম্ভাবনার দিকটা আমি বেশি দেখছি। নতুন রেলমন্ত্রীর পুরনো কথায় এলাকার মানুষ আরও হতাশ হলো। আমি একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজেও হতাশ হলাম।’

‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে সারাদেশের মানুষ চেয়ে আছে। বিশেষ করে বোয়ালখালীবাসীর মানুষ উনাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। এ ব্রিজটা যদি হয় তাহলে বোয়ালখালীর মানুষ উনার জন্য তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে দোয়া করবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামজ পড়ে দোয়া করবে। এখানকার মানুষ অনেক কষ্টে আছে। তারা কখনও চিন্তা করেনি নতুন সেতুর পরিবর্তে ফেরি পাবে। রেলমন্ত্রীর বক্তব্য বোয়ালখালীর মানুষ প্রত্যাখান করেছে।’— যোগ করেন এই জনপ্রতিনিধি।

বোয়ালখালী উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শামীম আরা বেগম বলেন, ‘একমাত্র কালুরঘাট সেতুর কারণে আমরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি, সরকারপ্রধান চাইলেই আন্তরিকতার মাধ্যমে এবং দায়িত্ব নিয়ে সেতুটি খুব কম সময়ে করতে পারেন। আশা করবো— ৪-৫ বছর নয়; ২-১ বছরের মধ্যে যেন কালুরঘাট সেতুর কাজ শুরু করা হয়।’

বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোমিন বলেন, ‘এটা দীর্ঘসূত্রতা। যা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়। নতুন সেতুর দাবিতে আন্দোলন চলছে অনেকদিন ধরে। রাজপথে আন্দোলন চলছে ২০১৪ সাল থেকে। জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি, দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত সমর্থন, একনেক থেকে ফিরিয়ে দেওয়া, নকশার পর নকশা; আরো অনেক কিছু দেখলাম শুনলাম। কয়েকদিন আগেও বলা হয়েছিল— এ বছরের মধ্যেই যেকোনো সময় সেতু নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে যাবে। আর এখন নতুন মন্ত্রী এসে আবার নতুন করে বলছেন, আরও ৪-৫ বছর সময় লাগবে। এটা আমাদের জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক, কষ্টদায়ক।’

তিনি বলেন, ‘একটি সেতুর জন্য বোয়ালখালীর মানুষ, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ অনেক কষ্টের মধ্যে আছে। যে সমস্ত নদীতে আগে ফেরি ছিল, সেখানে একটার পর একটা সেতু হচ্ছে। আর আমরা পাচ্ছি উল্টো ফেরি। সেই ফেরি সার্ভিসেও মহাদুর্ভোগ লেগেই আছে।’

বোয়ালখালীর বাসিন্দা জাকের হোসেন বলেন, ‘পত্রিকায় দেখেছি রেলমন্ত্রী চট্টগ্রামে আসছেন। ভেবেছিলাম, মন্ত্রী হয়তো নতুন সেতু নিয়ে কোনো বার্তা দিবেন আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে। এখন শুনছি, আরও ৪-৫ বছর লাগবে কালুরঘাট সেতু হতে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র হাসান কুতুব বলেন, ‘রেলমন্ত্রীকে কালুরঘাট সেতুতে মানুষের দুর্ভোগ দেখাতে আনলে ভালো হতো। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা উদ্যোগ নিতে পারতেন। উনি সরাসরি দেখে গেলে বিষয়টা নিয়ে ওনার একটা ব্যক্তিগত অবজারবেশন থাকতো।’

প্রয়াত এমপি মইন উদ্দীন খান বাদলের কথা স্মরণ করে বোয়ালখালীর বাসিন্দা ইব্রাহিম রেজভী বলেন, ‘বাদল সাহেব এমপি থাকাকালীন সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক সময় বলতেন, কালুরঘাটে নতুন সেতুর জন্য সাধারণ জনগণ তাঁর মৃত মা-বাবাকে গালি দেয়। উনার এ কথাগুলো এখনো কানে বাজে। কতটুকু কষ্ট পেলে তিনি এমন কথা বলতে পারেন! তিনি আজ বেঁচে নেই।’

‘সদ্য এমপি নির্বাচিত হওয়া আবদুচ ছালাম সাহেবও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন— তিনি নির্বাচিত হলে কালুরঘাট সেতু করবেন। অথচ এখন নতুন রেলমন্ত্রী জানাচ্ছেন— ‘ কালুরঘাট সেতু হতে ৪ থেকে ৫ বছর সময় লাগবে।’ এভাবে বোয়ালখালীর মানুষকে ঠকানো হচ্ছে। বারবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এ বছর হবে, ওই বছর হবে।’ – যোগ করেন ওপারের এই বাসিন্দা।

উল্লেখ্য, বুধবার চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন রেলমন্ত্রী। এর আগে পলোগ্রাউন্ডে বাংলাদেশ রেলওয়ে ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড আয়োজিত ৪৩তম বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন মন্ত্রী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d