ক্ষতি ১৬ কোটি টাকা, নিঃস্ব সহস্র খামারি
ফটিকছড়ির দাঁতমারা ইউনিয়নের কাছিমারখিল এলাকার বাসিন্দা মো. জমির উদ্দিন। বছর খানেক আগে একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে সাত লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্রয়লার মুরগির খামার শুরু করেন। খামার তৈরির পর গেল এপ্রিলে প্রথমবার মুরগির বাচ্চা লালন-পালন শুরু করেন। সেই মুরগি বিক্রির পর জুলাইয়ের শেষদিকে ফের দুই হাজার বাচ্চা তোলেন খামারে। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি জমিরের, তাই স্বপ্ন ছিল মুরগির খামারের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াবেন। তবে জমিরের সেই স্বপ্ন ভেসে গেছে সাম্প্রতিক বন্যায়। খামারে থাকা সবগুলো মুরগির মৃত্যুর পাশাপাশি হেলে পড়েছে খামার। খামারে থাকা মুরগির খাবারও নষ্ট হয়ে গেছে পানিতে। এক ধাক্কায় সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি। শুধু জমির নন, সাম্প্রতিক বন্যায় চট্টগ্রামে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন তার মতো সহস্রাধিক খামারি।
মূলত অতিবৃষ্টি ও প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আসা উজানের পানিতে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে চট্টগ্রামের মীরসরাই, ফটিকছড়ি, হাটহাজারীসহ অন্তত ৭ উপজেলা।
এসব উপজেলায় ঘরবাড়ি-দোকানপাটসহ নানা স্থাপনার পাশাপাশি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে গবাদি পশু-পাখির সহস্রাধিক খামার। এতে হাজার হাজার গবাদি পশু-পাখির মৃত্যু ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আড়াই শতাধিক খামার। জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসেবে চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক বন্যায় এখন পর্যন্ত পোল্ট্রি ও ডেইরিখাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৬ কোটি টাকার বেশি।
খামারিরা জানান, বন্যায় কারো খামারের গরু, কারো খামারের মহিষ কিংবা কারো খামারের মুরগি মারা গেছে। এছাড়াও খামারে থাকা মুরগির খাবার, গবাদি পশুর দানাদার খাবার ছাড়াও খড়-ঘাস, দুধ ও ডিম নষ্ট হয়েছে বন্যায়। কোথাও কোথাও খামারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক বন্যায় চট্টগ্রামে অন্তত ৭ টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকায় পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতে সব মিলিয়ে ১৬ কোটি ১ লাখ ১২শ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২ কোটি ৯০ লাখ ৭৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে মীরসরাইয়ে। সবচেয়ে কম ১১ লাখ ৬৯ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে সীতাকুণ্ডে। এর বাইরে ফটিকছড়িতে এক কোটি ৬৩ লাখ ৮৫ হাজার ২০০, হাটহাজারীতে ২৬ লাখ ৫৭ হাজার, রাউজানে ৩৭ লাখ সাত হাজার ৮০০, রাঙ্গুনিয়ায় ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ২০০ এবং পটিয়ায় ২১ লাখ ৪৮ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এসব উপজেলায় গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মুরগি ও হাঁস মিলিয়ে ২ লাখ ৩৭ হাজার ১২৪ টি প্রাণি মারা গেছে বন্যায়। এসব মৃত পশুপাখির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি ৬৭ লাখ ৭২ হাজার ২০০ টাকা। বন্যায় গবাদি পশুর ১৮৬ টি এবং হাঁস-মুরগির ৯৯ টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে অন্তত ২ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর বাইরে পশুপাখির ৩৭ দশমিক ৭ টন দানাদার খাবার, ১৫২ দশমিক ৩ টন খড় এবং ৭১৪ দশমিক ৬ টন খাবার নষ্ট হয়েছে বন্যায়। এতে অন্তত এক কোটি ১৬ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে খামারিদের।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত বন্যায় ডেইরি ও পোল্ট্রি খাতে ১৬ কোটি এক লাখ ১২শ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তবে এখনও বন্যার পানি পুরোপুরি নামেনি। নতুন নতুন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই ক্ষয়ক্ষতির এই তালিকা প্রতিদিন হালনাগাদ করা হচ্ছে।
তবে খামারিদের মতে বন্যায় সব মিলিয়ে পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতে আর্থিক পরিমাণ শত কোটি টাকার বেশি। কেবল পোল্ট্রি খাতেই ২০ কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি রিটন প্রসাদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এখনও বন্যার পানি পুরোপুরি না নামায় আমরা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ করতে পারিনি। তবে আমরা এখন পর্যন্ত যা খবর পাচ্ছি, শুধু মৃত মুরগির আর্থিক পরিমাণই ২০ কোটি টাকার বেশি হবে।
একইভাবে ডেইরি খাতেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসেবের চেয়ে অনেক বেশি বলে দাবি করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মালিক মোহাম্মদ ওমর। তিনি বলেন, ‘বন্যায় মীরসরাই-সীতাকুণ্ড আর ফটিকছড়ি এলাকার খামারিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখনও সব খামারির সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তবে যে খবর পাচ্ছি, অন্তত এক হাজার পশু মারা গেছে। আর শুধু মৃত পশুর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণই ২০ কোটি টাকার বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত খামারসহ সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ শতকোটি টাকার বেশি হবে।
বন্যাকবলিত ফটিকছড়ির খামারি জমির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের এলাকায় কখনোই এত পানি হয় না। যেদিন পানিতে আমার খামার ভেসে যায় সেদিনও ফজরের নামাজের পর দেখেছি পানি অনেক নিচে, তাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক পর ঘুম থেকে উঠে দেখি সব ভেসে গেছে। সব মুরগি মরে গেছে, খামারে থাকা খাবারও নষ্ট হয়ে গেছে।’ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সব খামারিকে পুনর্বাসনের দাবিও জানান জমির উদ্দিন।