অর্থনীতিজাতীয়

ঘনঘন বিদেশ ভ্রমণে আসছে নিষেধাজ্ঞা

অর্থ পাচার, হুন্ডি ও স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। নগদ ডলার পাচার ও স্বর্ণের চোরাচালান রোধে কাজ শুরু হয়েছে। বৈধভাবে বিদেশ থেকে স্বর্ণ আমদানি কমানোর জন্যও নেওয়া হয়েছে উদ্যোগ।

একটি চক্র নানা প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে এসব পাচার করতে ঘনঘন বিদেশ যাচ্ছেন। তাদের পারিবারিক অবস্থা তেমন ভালো না, বিদেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রমও নেই। বিদেশ থেকে আনা স্বর্ণে তাদের নিজস্ব কোনো বিনিয়োগও নেই। শক্তিশালী গডফাদার চক্রের সহায়তায় তারা ক্যারিয়ার হিসাবে ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার নামে দেশ থেকে নগদ ডলার পাচার করছে। প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স নিয়ে স্বর্ণ কিনে দেশে আনছেন। সেই স্বর্ণ বিক্রির টাকায় ডলার কিনে ফের বিদেশ যাচ্ছে।

এসব বন্ধে ঘনঘন বিদেশ সফরকারীদের তালিকা তৈরি শুরু করেছে সরকার। টাকা পাচারের উদ্দেশ্যে কেউ যাতে বিদেশ সফর করতে না পারে, সেজন্য এই চক্রের একটি তালিকা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোয় পাঠানো হয়েছে।

জানা যায়, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মধ্যে গত এক বছরে কে কতবার বিদেশ গেছেন, ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে তার একটি তালিকা চেয়ে চিঠি দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অর্থ পাচার ও স্বর্ণের চোরাকারবার রোধে ১২ সদস্যের ৪টি সার্ভিল্যান্স টিমও গঠন করেছে। একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে চার শিফটে তারা বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালন করবেন।

বিমানবন্দর কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু মানুষ ঘনঘন বিদেশ যাচ্ছেন। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ও সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। ২/১ দিন থেকেই আবার দেশে ফিরে আসছেন। এভাবে এক মাসের মধ্যে তিন-চারবার বিদেশ সফরের নজিরও রয়েছে। তাদের বিষয়ে গোয়েন্দারা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, তারা খুব সাধারণ মানুষ। আর্থিক অবস্থাও ভালো না। বিদেশে ব্যবসায়িক কোনো কর্মকাণ্ডও নেই। নিজের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করার সক্ষমতাও নেই। মূলত তারা পাচারকারী গডফাদারদের ক্যারিয়ার হিসাবে এসব সফর করছেন। হুন্ডিবাজরা স্বর্ণ কিনে ক্যারিয়ারের মাধ্যমে দেশে পাঠায়। এখন থেকে ক্যারিয়ারের স্বর্ণ কেনার অর্থের উৎসের বিষয়ে কড়াকড়িভাবে হিসাব নেওয়া হবে। বিশেষ করে সাধারণ ব্যক্তিরা যারা ঘনঘন বিদেশ যাচ্ছেন, প্রথমে তাদের চিহ্নিত করা হবে। এরপর তাদের গডফাদারদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের আওতায় আনা হবে। এর ফলে হুন্ডির অর্থে স্বর্ণসহ মূল্যবান পণ্য এনে দেশে ও পার্শ্ববর্তী দেশে বিক্রি বন্ধ হবে। যথাযথভাবে এ কার্যক্রম চললে ধীরে ধীরে হুন্ডির পরিমাণ কমে আসবে এবং রেমিট্যান্স আসার হার বাড়তে থাকবে।

গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এসব ব্যক্তি বিদেশ যাওয়ার সময় ভ্রমণ কোটা অনুযায়ী ১২ হাজার ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। খরচ করছেন ১০০ ডলারেরও কম। বাকি ডলার বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। বিদেশ থেকে দেশে আসার সময় ব্যাগেজ রুলের আওতায় ১১৭ গ্রাম ওজনের স্বর্ণবার নিয়ে আসছেন। এসব স্বর্ণ বিদেশে কেনা হচ্ছে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের অর্থে। দেশে তাদের আত্মীয়স্বজনকে টাকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা এলো না। এভাবে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসায় দেশ বঞ্চিত হচ্ছে প্রবাসীদের ডলার থেকে। আবার বিদেশে যাওয়ার সময় ডলার নিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরেও অনেকে বিদেশ থেকে প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তা নগদ ডলার আকারে এনে দেশের কার্ব মার্কেটে তা বিক্রি করে দিচ্ছেন চড়া দামে। ওইসব ডলারও বিদেশ চলে যাচ্ছে। ঢাকায় ডলারের কার্ব মার্কেটগুলোয় নতুন বান্ডিল আকারে ডলার পাওয়া যাচ্ছে। যেগুলো দেখলে মনে হবে ব্যাংক থেকে তোলা। বিদেশ থেকে প্রবাসীদের মাধ্যমে নগদ ডলার তুলে সেগুলো দেশে পাঠিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।

ঢাকা কাস্টম হাউজ সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা কে কতবার বিদেশ গেছেন, তা জানতে গত সপ্তাহে স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ (ইমিগ্রেশন) বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘রাজস্ব সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, চোরাচালান ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করছে ঢাকা কাস্টম হাউজ। বিদেশ থেকে শুল্ক ফাঁকি, নিষিদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত পণ্য পরিবহণসহ চোরাচালানের দায়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং এ সংক্রান্ত মামলাগুলো বিচারাধীন রয়েছে। এসব যাত্রীর মাধ্যমে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পরিবহণ ও পাচারের ঝুঁকি রয়েছে। সন্দেহভাজন পাসপোর্টধারী যাত্রীরা বিদেশ ভ্রমণকালে বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো। একই সঙ্গে যাত্রীরা এক বছরে কোন কোন দেশে কতবার ভ্রমণ করেছেন, তা জানানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। সরকারি রাজস্ব সুরক্ষা, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধকল্পে বিষয়টি অতিজরুরি।’

প্রসঙ্গত, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির তথ্য অনুযায়ী, দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে। বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হচ্ছে। ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d