চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় এক বছরে হয়নি মামলা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের নিয়োগ সংক্রান্ত কয়েকটি ফোনালাপ গত বছর ফাঁস হয়।শিক্ষক নিয়োগে ‘দরকষাকষি’র সেই আলাপে নিয়োগের বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতে শোনা যায়।ফোনালাপের তিনটি ক্লিপ ২০২২ সালের মার্চ মাসে ফাঁস হয়ে যায়।
ক্লিপে একজন আবেদনকারীর কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা দাবি করা হয়। বলা হয়, তৃতীয় শ্রেণির একটি চাকরির জন্য এখন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা লাগে। মালি, প্রহরীর মতো চতুর্থ শ্রেণির চাকরির জন্য লাগে আট লাখ টাকা।
ফাঁস হওয়া ফোনালাপে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ’ করতেই অর্থের প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়।
ওই ঘটনায় অভিযোগের তির যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সেই সময়কার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) ও উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক খালেদ মিছবাহুল মোকর রবীন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টস শাখার কর্মচারী আহমদ হোসেনের বিরুদ্ধে, তবে তখন অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্যের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এরপর সমালোচনার মুখে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ফারসি বিভাগের নিয়োগ বোর্ডটি বাতিল করে। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গঠন করে তদন্ত কমিটি।
এ বিষয়ে ওই বছরের মার্চ মাসে ‘চবির ফারসি বিভাগের সেই নিয়োগ বাতিল’ শিরোনামে নিউজবাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থ লেনদেনসংক্রান্ত অডিও ফাঁসসহ নানা অনিয়মের ঘটনায় সমালোচনার মুখে চবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে সিন্ডিকেট।
নিয়োগে অনিয়মে জড়িতদের শনাক্তে চার সদস্যের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি করে তাদের তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়।
ওই সময় এক চিঠিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান।
এরপর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী ৫৩৮তম সিন্ডিকেটে (জরুরি) উপাচার্য শিরীণ আখতারের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) খালেদ মিছবাহুল মোকর রবীনকে পদাবনতি (ডিমোশন) এবং কর্মচারী আহমদ হোসেনকে চাকরিচ্যুত করার সুপারিশ করা হয়। ঘটনার ‘নেপথ্যের কারিগরদের’ বের করতে পিএস রবিন ও কর্মচারী আহমদ হোসেনের পাশাপাশি অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে জরুরি ভিত্তিতে থানায় ফৌজদারি মামলা করার সুপারিশও করা হয়।
ওই সিন্ডিকেট সভায় দুজনের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশের পাশাপাশি অধিকতর যাচাই-বাছাই করার লক্ষ্যে দ্বিতীয় আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়। দ্বিতীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে এ বিষয়ে আসামিদের শাস্তি কার্যকর হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঘটনার পরপরই তদন্তের স্বার্থে খালেদ মিছবাহুল মোকর রবীন ও আহমদ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রশাসন। কয়েক মাস পরে রবীনের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত বরখাস্তের আদেশের বিষয়ে তিন মাসের স্থগিতাদেশ দেয়। পরে কয়েক দফা স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ায় আদালত।
অন্যদিকে সম্প্রতি আরেক অভিযুক্ত কর্মচারী আহমদ হোসেনও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে চাকরিতে যোগদান করেন। ফলে স্বপদে বহাল আছেন খালেদ মিছবাহুল মোকর রবীন ও আহমদ হোসেন।
দ্বিতীয় তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ও গোপনীয় শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার সৈয়দ ফজলুল করিম জানান, কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের প্রমাণ পেলে দুটি তদন্ত কমিটি হয়। প্রথম কমিটি শাস্তির সুপারিশ করলে দ্বিতীয় কমিটি সেটি আবার অধিকতর যাচাই-বাছাই করে। দ্বিতীয় কমিটির সুপারিশের আলোকে শাস্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি আসে।
এরপর দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনায় মামলা করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ১১ মাস পর গত ২৩ জুলাই প্রতিবেদন জমা দেয় দ্বিতীয় তদন্ত কমিটি।
কমিটির আহ্বায়ক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ প্রতিবেদন জমা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এদিকে প্রতিবেদন জমার প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো সিন্ডিকেট সভা না হওয়ায় এ বিষয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
মামলা না করা ও ‘অডিও কেলেঙ্কারি’তে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে ধীরগতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকেও চিঠি দিয়ে মামলা করার বিষয়ে আলটিমেটাম দেয়া হয়।
চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক বলেন, ‘মামলা করতে এত সময় লাগার কথা না। সিন্ডিকেট থেকেও মামলা করার কথা বলা হয়েছে। অডিও কেলেঙ্কারিতে যাদের সম্পৃক্ততা আছে, নেপথ্যের কারিগরদের খুঁজে বের করে আনতে মামলা করার কথা আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি।
‘এ দাবি আমাদের শুরু থেকেই। আমরা এটি থেকে সরে আসিনি। যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আসল নিয়োগসংক্রান্ত বাণিজ্য চক্র বেরিয়ে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মনে হয়, নিয়োগসংক্রান্ত বাণিজ্য চক্রকে ধরতে প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। মামলা না করায় যাদের ব্যাপারে অডিও কেলেঙ্কারির অভিযোগ তাদেরকে সুরক্ষা ও প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে ও নেপথ্যে যারা আছে তাদেরকেও সামনে আসতে দেয়া হচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে।’
তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদন জমা দিয়েছি প্রায় দুই মাস পার হয়ে তিন মাস হয়ে যাচ্ছে। এখন উপাচার্য সিদ্ধান্ত নেবেন।
‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও শুদ্ধাচারের স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে সিন্ডিকেট ডেকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি। চবির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমদ বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। সেটা আগামী সিন্ডিকেটে যবে। সিন্ডিকেটে যাওয়ার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
খালেদ মিছবাহুল মোকর রবিন ও আহমদ হোসেনের বিষয়ে উচ্চ আদালত স্টে অর্ডার দিয়েছে। এ কারণে তারা চাকরিতে আছেন বলেও জানান তিনি।