চট্টগ্রামমীরসরাই

ছিলেন কৃষক, এখন ব্যবসায়ী—একটি ঝর্ণা ওদের জীবন বদলে দিয়েছে

ছিলেন কৃষক, এখন ব্যবসায়ী—একটি ঝর্ণা ওদের জীবন বদলে দিয়েছে

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের পূর্ব খৈয়াছড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. শামসুদ্দিন (৪৫)। ২ বছর আগেও অন্যের কাছ থেকে বর্গা নেওয়া জমিতে করতেন চাষাবাদ। ভোর বেলা হালের গরু নিয়ে ফসলের মাঠে ছুটে যেতেন। দিনভর তীব্র রোদে পুড়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফিরতেন সন্ধ্যায়। কোনো কোনো বছর ফসল তুলে লাভবান হতেন। আবার কোনো কোনো বছর বর্গা জমির খাজনা দিতেও হিমশিম খেতেন। ‘অফ সিজনে’ সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরাতো।

কিন্তু এখন শামসুদ্দিন একজন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। স্ত্রী আকলিমা আক্তারকে নিয়ে পরিচালনা করছেন একটি ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট। দেশি হাঁস, মুরগি, কবুতর, মাছ, মাংস আর ভাত রান্না করে বিক্রি করছেন। বেচা-কেনাও হরদম হচ্ছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাবলম্বী হয়েছেন শামসুদ্দিন। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। করেছেন পাকা বাড়িও।

কৃষক শামসুদ্দিনের ব্যবসায়ী বনে যাওয়া আর জীবন বদলে যাওয়ার পেছনে রয়েছে দুর্গমের পাহাড়ের শীতল পানির একটি ঝর্ণা। পাহাড়ের গহীন হতে প্রবাহিত হচ্ছে মিরসরাই উপজেলার এই ঝর্ণাটির নাম ‘খৈয়াছড়া ঝর্ণা’। খৈয়াছড়া ইউনিয়নে অবস্থিত বলে এটিকে খৈয়াছড়া নামকরণ করা হয়েছে।

তবে ঝর্ণাটি শনাক্ত করতে বেশ সময় লেগেছে। ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে গত ৫-৬ বছর ধরে ধীরে ধীরে খৈয়াছড়া ঝর্ণার সৌন্দর্যের কথা সারাদেশে ছড়িয়ে যেতে থাকে। দিনদিন প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের কাছে টানতে সক্ষম হয় এটির অপার, মোহনীয় সৌন্দর্য। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খৈয়াছড়া ঝর্ণা। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে ঘুরতে এসে তৈরি করেন নানারকম এ্যাডভেঞ্চার ব্লগ। এসব ব্লগ দেখে দেখে আকৃষ্ট হয়ে আরও নতুন নতুন পর্যটক এখানে ভিড় করতে থাকেন। একসময় বাড়তে থাকে বিভিন্ন জিনিসপত্রের চাহিদা। খৈয়াছড়া ঝর্ণাকে ঘিরে বদলে যেতে শুরু করে সেখানকার স্থানীয়দের একাংশের জীবন-জীবিকা।

ক্ষুদ্র পরিসের অনেকেই শুরু করেন ব্যবসা। উঁচু পাহাড় হওয়ায় পর্যটকদের ওঠতে কষ্ট হয় তাই কেউ বিক্রি করতে থাকেন পাহাড়ি বাঁশের লাঠি। ঝিরিপথে পাথরের কণা পায়ে লেগে পর্যটকরা আঘাত পান। এজন্য কেউ শুরু করেন পায়ের এংলেট বিক্রি৷ ঝর্ণায় নেমে গোসল করার সুবিধার জন্য কেউ কেউ শর্ট, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট বিক্রি করতে শুরু করেন৷ তীব্র রোদে পুড়ে পর্যটকদের গলা শুকিয়ে যায়, অনেকে শক্তি হারিয়ে ফেলেন৷ এসব চিন্তা করে স্থানীয়দের কেউ বিক্রি করছেন পানির বোতল, কেউ সিদ্ধ ডিম, কেউবা ঘরে হাতের বানানো নাস্তা।

আবার ঝর্ণা ঘুরে ফেরার সময় অনেকে ভালো পানিতে হাত-পা পরিষ্কার করতে চান। এজন্য কেউ কেউ কূপের পানিতে ওয়াশ করার সুযোগ তৈরি করে টাকা রোজগার করছেন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও করছেন টুকটাক ব্যবসা। কেউ পায়ের এংলেট, কেউ জুতা-ব্যাগ জমা নিয়ে অর্থ আয় করছেন। গ্রামের কোনো কোনো যুবক কাজ করছেন পর্যটকদের গাইড হিসেবে। কেননা দুর্গম পাহাড়ি আঁকাবাঁকা ঝিরিপথ, গিরিপথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই পথ হারিয়ে ফেলেন।

এভাবেই খৈয়াছড়া গ্রামের ভিতরে এখন জমজমাট ব্যবসা চলছে। ধীরে ধীরে বাড়ির সামনেই অনেক খুলে দিয়েছেন ঘরোয়া হোটেল। ব্যানার, পোস্টারে নানারকম অফার জুড়ে দিয়ে ভাতের ব্যবসা করছেন গ্রামের কৃষকরা।

গত ৬ বছরে খৈয়াছড়া ঝর্ণায় অন্তত ২০টি হোটেল চালু হয়েছে। এসব হোটেলের সবকটি স্থানীয়রা পরিচালনা করে থাকেন। এছাড়াও আচার, ঝালমুড়ি, পানি, সিদ্ধ ডিম, বাঁশের লাঠি, কাপড়, এংলেট, মোবাইলের ব্যাগ, শরবত, নাস্তার দোকান গড়ে ওঠেছে শতাধিক। এসব দোকান যারা পরিচালনা করেন তাদের প্রত্যেকেই আগে কৃষির কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আবার কেউ দিনমজুর হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতেন। কিন্তু এখন সবাই ব্যবসায়ী।

আমির হোসেন কয়েক বছর আগেও সমতলে ধান আর পাহাড়ে সবজি চাষাবাদ করতেন। এখন তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে দিয়েছেন একটি হোটেল। তার স্ত্রী রান্নাবান্নার কাজ করেন। আর তিনি একজন শ্রমিক নিয়ে পর্যটকদের খাবার-দাবার পরিবেশন করেন। একইসাথে ক্যাশিয়ারের কাজও করেন তিনি।

সবুজ আগে ছিলেন ইলেকট্রিশিয়ান। কখনও কাজ থাকতো, কখনও থাকতো না। গ্রামে পর্যটকদের ভিড় বাড়ায় নিজেই বাড়ির সামনের একটি জায়গায় দিয়েছেন জার্সি কাপড় ও এংলেটের দোকান। বেশ ভালোই চলছে তার ব্যবসা।

রহিমা বেগম ওই গ্রামের একজন কৃষাণী। পর্যটকদের চাপ বাড়লেও খৈয়াছড়া গ্রামে গাড়ি রাখার কোনো সুব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে বাইকারদের দল যখন বেড়াতে আসেন তখন তারা বিপাকে পড়েন শখের বাইক রাখা নিয়ে। এ কথা চিন্তা করে রহিমা তার বাড়ির উঠানে বাইক পার্কিংয়ের ব্যবসা শুরু করেছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি শুক্রবার ও বিভিন্ন ছুটির দিনে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয় তার৷ প্রতিটি বাইক পার্কিংয়ে ৫০ টাকা করে নিয়ে থাকেন তিনি। পর্যটকরাও স্বাচ্ছন্দ্যে নিরাপদে তার বাড়ির উঠানে বাইক রেখে যাচ্ছেন।

ইকবাল খৈয়াছড়া গ্রামের বেকার যুবক। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একদিন দেখলেন একদল পর্যটক বলাবলি করছেন তাদের দামী মোবাইল ফোন পানিতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ইকবাল তার এক বন্ধুর কাছে দেখেছেন মোবাইল ফোনকে পানি থেকে বাঁচাতে বিশেষ ব্যাগ ব্যবহার করতে। ঠিক করলেন খৈয়াছড়ায় এ ধরণের ব্যাগ বিক্রি শুরু করবেন। এরপর তিনি কয়েক প্রকার আইটেম নিয়ে একটি দোকান দিয়ে দেন। এখন ইকবালের দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০ টি মোবাইল ব্যাগ বিক্রি হয়৷ বিক্রি বাড়াতে ইকবাল দিচ্ছেন বিশেষ ছাড়ও।

একইভাবে ফয়সাল, মোবারক, আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন, আহম্মেদ, বশির তারা প্রত্যেকেই ছিলেন গ্রামের কৃষক, খামারি, দিনমজুর। আর খৈয়াছড়া ঝর্ণার বদৌলতে তারা এখন সবাই ব্যবসায়ী। ব্যবসা করে স্বাবলম্বীও হয়েছেন তারা। ঘুরে গেছে অনেকের জীবনের মোড়ও। সেইসাথে বদলে গেছে এখানকার জীবিকার উৎস৷

ব্যবসায়ী মো. সবুজ বলেন, দিনে নূন্যতম ৫০ জন পর্যটক খৈয়াছড়া ঝর্ণায় বেড়াতে আসেন। শুক্রবার ও ছুটির দিনগুলো ২-৩ হাজার পর্যটকের ভিড় হয় এখানে। এই সময়ে বেচা-বিক্রি সবচেয়ে বেশি। কোনদিন কম বিক্রি হলেও ছুটির দিনে সেটি পুষিয়ে আসে।

শামসুদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামের অনেকেই ভাতের হোটেল প্রতিষ্ঠা করেছেন। পর্যটকরা এসব হোটেলে আগে থেকে অর্ডার করে যান। দুপুরে বা বিকেলে ফেরার পথে তারা খাবার গ্রহণ করেন। তিনি আরও বলেন, ঘরোয়া পরিবেশের রান্না পর্যটকদের বেশি আকৃষ্ট করে। তাছাড়া দামও হাতের নাগালে। ফলে জমে উঠেছে এখানাকার ঘরোয়া হোটেলগুলোর ব্যবসা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খৈয়াছড়া ঝর্ণা সংলগ্ন পূর্ব খৈয়াছড়া গ্রামের ৫ শতাধিক মানুষ এখন ছোট-বড় মিলিয়ে এসব ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহের সাথে জড়িত। তাদের কেউ পুরো সময় ব্যবসা করছেন। আবার কেউ অর্ধেক সময় কৃষি, জুম চাষ বাকি অর্ধেক ব্যবসায়৷ যার উপর নির্ভর করছে ওই গ্রামের অন্তত দেড় হাজার থেকে দুই হাজার মানুষের জীবন।

খৈয়াছড়া ঝর্ণা ঘুরে কথা হয় নুসরাত জাহান, মাঈনুদ্দিন, দিদারুল আলমসহ বেশ কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে। তারা জানান, খৈয়াছড়া ঝর্ণায় যাওয়ার পথে যে দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট রয়েছে তারা শুধু ব্যবসাই করছে না। পাহাড়ে যাওয়ার পথে তারা পর্যটকদের সতর্ক করছেন। যেখানে বন বিভাগ ও ইজারাদার কোনো ধরণের সতর্কতামূলক নির্দেশনাও দেয়নি, সেখানে ব্যবসায়ীদের নির্দেশনাগুলো থেকে অনেক পর্যটক সতর্ক হচ্ছেন। এতে ভ্রমণ হচ্ছে আরও রোমাঞ্চকর ও নিরাপদ। তাছাড়া প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্রের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে এসব দোকানের বদৌলতে।

মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়নে বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের আওতায় থাকা এ ঝর্ণাটি বন বিভাগ ইজারা দিয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে প্রায় এক কিলোমিটার যেতে হয় সিএনজি অটোরিকশায় চেপে। ২০ টাকার টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয় মূল ট্রেকিংয়ে। এরপর পায়ে হেঁটে যেতে হয় আরও অন্তত ৪ কিলোমিটার ঝিরি ও গিরিপথ। এখানকার পাহাড়গুলো বেশ উঁচু। বর্ষাকালে পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে এ পথ। এজন্য অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। খৈয়াছড়া ট্রেইল ট্রেকিংয়ে রয়েছে মোট ১২টি ঝর্ণা। প্রত্যেকটি ঝর্ণায় শীতল পানির অবিরাম ধারা বয়ে যাচ্ছে। মনোমুগন্ধকর এই দৃশ্য উপভোগে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকরা ছুটছেন খৈয়াছড়ায়। তবে অসতর্কতা, অসাবধানতায় প্রায় ঘটছে মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। গেল বছর খৈয়াছড়ায় যাওয়ার পথে রেলক্রসিংয়ে মাইক্রোবাসে ধাক্কা দেয় দ্রুতগামী ট্রেন। এতে ১৪ জন পর্যটক প্রাণ হারায়৷ এছাড়াও ঝর্ণার কূপে গোসল করতে নেমে ডুবে গিয়ে, কিংবা পা পিছলে পড়ে মৃত্যু হয়েছে অনেকের।

স্থানীয়দের ভাষ্য, খৈয়াছড়া ঝর্ণায় যাওয়ার একমাত্র গ্রামের রাস্তাটির অবস্থা বেশ খারাপ। দক্ষ, সচেতন ইজারাদার, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে ঘটছে দুর্ঘটনা৷ সেখানে টুরিস্ট পুলিশের ক্যাম্প স্থাপন, সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত, সড়ক তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা গেলে খৈয়াছড়া ঝর্ণা হয়ে উঠবে উত্তর চট্টগ্রামের সবচেয়ে ব্যস্ততম পর্যটন স্পট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d