পাঁচ বছরে মানিলন্ডারিং মামলা দুটি !
প্রতিদিন ইয়াবা উদ্ধার করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। চট্টগ্রামের থানাগুলোতে বছরে ইয়াবা সংক্রান্ত মামলা হচ্ছে তিন হাজারের বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়ছে বহনকারী। পরবর্তীতে বহনকারীদের বিরুদ্ধেই দেয়া হচ্ছে তদন্ত প্রতিবেদন। এতে মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তদন্তে মূল পাচারকারীর তথ্য উঠে আসলে মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের করা মামলায় বন্ধ করা যেতো মাদক পাচারের অর্থের উৎস। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল মাদক পাচার ও চোরচালান বন্ধ করা। অথচ এসব অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে খুবই কম। বিগত পাঁচ বছরে চট্টগ্রামে এ আইনে মামলা দায়ের হয়েছে মাত্র দুটি। এ আইনে ২৭ অপরাধের মধ্যে ২৫ ধরনের অপরাধ সিআইডির তফসীলভুক্ত।
তবে সিআইডি জানিয়েছে, মাদক পাচারে যাদের বিরুদ্ধে তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন দিচ্ছে তাদের সবাই বহনকারী। মূল পাচারকারীর তথ্য তদন্তে উঠে আসছেনা। আর মুল পাচারকারী না পেলে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা দাঁড় করানো যায় না। মাদক বিক্রির টাকা লেনদেনের মাধ্যমে ব্যাংক হিসাবসহ বেনামে সম্পদ অর্জনের অপরাধে আনোয়ারার ইয়াবা পাচারকারী মোজাহেরের বিরুদ্ধে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মানিলন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করেছিল সিআইডি। ২০১৮ সালের ৩ আগস্ট সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের (ইকোনোমিক ক্রাইম স্কোয়াড) পুলিশ পরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম বাদী হয়ে দায়ের করা এ মামলায় মোজাহের, তার স্ত্রী ও আট সহযোগীকে আসামি করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে উঠে আসে ইয়াবা পাচার করে মোজাহের এ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দৃশ্যমান কোন ব্যবসা না থাকলেও ক্রোকারিজ ব্যবসার নামে নগরীর সিডিএ এভিনিউ এলাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকে নিজ ও স্ত্রীর নামে খোলা চারটি হিসাবে আড়াই বছরে তার লেনদেন হয়েছে ১২ কোটি ২০ লাখ টাকা। চারটি হিসাবের লেনদেন স্থগিত করে বিএফআইইউ। ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল মোজাহেরকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গ্রেপ্তারের এক বছরের বেশি সময় পর ২০১৮ সালের আগস্টে মোজাহেরের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে এ মামলা দায়েরর পর এ আইনে আর কোন মামলা হয়নি। পরবর্তীতে মোজাহেরের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগ উঠেনি আর। অথচ দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময়ে নগরীতে ইয়াবা পাচারের অপরাধে মামলা হয়েছে কয়েক হাজার। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের উদ্দেশ্যই ছিল ২৭ অপরাধের মধ্যে মাদক পাচারের অর্থের উৎস বন্ধ করা। দেশে সবচেয়ে বেশি মাদক পাচারের মামলা দায়ের হয় চট্টগ্রাম বিভাগে। অথচ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এ মানি লন্ডারিং আইনে মামলা সবচেয়ে কম। সিআইডি চট্টগ্রামের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ জানান, থানায় দায়ের হওয়া ইয়াবা মামলাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৫/২০/৫০ পিস ইয়াবা দিয়ে মামলাগুলো হয়। পরে দেখা যায় বহনকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়। মূলহোতা তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে না। বেশি পরিমাণ ইয়াবা ধরা পড়লে কিংবা মামলার তদন্তে মূল হোতার ব্যাপারে তথ্য উঠে আসলে সিআইডি সেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিয়ে মামলা দায়ের করে এবং তদন্ত করে। মূলহোতার তথ্য না পেলে এ আইনে মামলা দাঁড় করানো যায় না।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে মানি লন্ডারিংয়ে তেমন মামলা নেই। বিগত পাঁচ বছরের অধিক সময়ে ইয়াবা পাচারকারী টেকনাফের হ্নীলার শাহ আজম ও আনোয়ারার হাসান মাঝির বিরুদ্ধে দুটি মানিলন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে। কক্সবাজারে ছয় মাদক কারবারির বিরুদ্ধে মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হলে মাদকের অর্থের উৎস বন্ধ হয়। বাস্তবতা হচ্ছে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধিকাংশ কর্মকর্তার ধারণা নেই। তবে সিআইডি ফিন্যান্সিয়াল ইনটিলিজেন্সের উপর এ ব্যাপারে তিন মাসের ট্রেনিং দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (চট্টগ্রাম মেট্টো-উত্তর) হুময়ন কবির খোন্দকার জানান, ইয়াবা নিয়ে যারা ধরা পড়াদের অধিকাংশ বহনকারী। মূল পাচারকারীদের হাতেনাতে তেমন পাওয়া যায়নি। আর বহনকারিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা দিয়ে তেমন সুফল পাওয়া যায়না। এ আইনে আমরা ৪/৫টি মামলা করেছি। যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা অফিস থেকে তদারকি করা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে দুর্নীতি ও ঘুষ সংক্রান্ত মানি লন্ডারিং অপরাধ তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এর বাইরে ২৫টি অপরাধ তদন্ত করতে পারবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি ছাড়াও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কাস্টমস, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন তদন্ত করার ক্ষমতা রাখে।