বরিশালে ছাত্রদের দুই পক্ষের সংঘর্ষের নেপথ্যে বাড়ির মালিকানা বিরোধ
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) ও সরকারি ব্রজমোহন কলেজের (বিএম) শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাতভর দফায় দফায় সংঘর্ষে উভয়পক্ষের শতাধিক আহত হয়েছেন। দুই পরিবারের বাড়ির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধে এ সংঘর্ষ হয়েছে বলে জানা গেছে।’
মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যা দফায় দফায় হামলা ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ভোর ৫টা পর্যন্ত চলে। কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান সংঘর্ষের তথ্য নিশ্চিত করেন।
স্থানীয়, শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বরিশাল নগরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডের বাসিন্দা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভা চৌধুরী জোয়া’র পরিবারের সঙ্গে জমি নিয়ে প্রতিবেশী একটি পরিবারের বিরোধ দীর্ঘদিনের।
সোমবার বিএম কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যে ঘটনাস্থলে যান। তাদের সঙ্গে জোয়া’র পরিবারের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে জোয়া তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের বিষয়টি জানান।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা গিয়ে জানতে পারেন জোয়া ও তার মাকে হেনস্তা-অপমান করা হয়েছে। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ববি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি হামলা-হেনস্তার ঘটনা ঘটে।
পরে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে সরে যান। এরপর হামলা ও হেনস্তার অভিযোগ এনে মঙ্গলবার বিকেলে পাল্টাপাল্টি মানববন্ধন করেন উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে নগরের বটতলা এলাকায় ববির দুই শিক্ষার্থীকে পেয়ে মারধর করেন বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা। তখন প্রাণ বাঁচাতে ওই দুজন দৌড়ে পাশেই থাকা বটতলা পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকে আশ্রয় নেন।
সহপাঠীদের মারধরের খবর পেয়ে রাত ১২টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ থেকে ৫০ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে করে সেখানে যান। বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা সেই বাসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন। এতে বাসের চালকসহ ১৫ থেকে ২০ জন আহত হন।
সহপাঠীদের মারধরের খবর পৌঁছলে বাস-ট্রাকে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নগরের বটতলা এলাকার আশপাশে এসে জড়ো হন। অন্যদিকে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাস ও তার আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন। এ সময় বিভিন্ন স্থানে উভয় পক্ষের শিক্ষার্থীদের মাঝে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
রাত ১টা থেকে পৌনে ৩টা পর্যন্ত বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে ববি শিক্ষার্থীরা হামলা চালান। হামলার প্রথম পর্যায়ে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা পাল্টা হামলা চালানোর চেষ্টা করলেও সংখ্যায় অনেক কম হওয়ায় খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদেরসহ সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালিয়েছেন। তাদের দাবি- বিএম কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এক শিক্ষার্থী জমি দখল করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জোয়া ও তার পরিবারকে হেনস্তা করেছে। এর প্রতিবাদ জানাতে গেলে ববি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়।
অভিযোগ অস্বীকার করে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, বিরোধ সমাধানে গিয়ে সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর রহমান রাফিসহ বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা হামলার শিকার হন। এর প্রতিবাদ জানাতে গেলে রাতে ববি শিক্ষার্থীরা বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান এবং প্রশাসনিক ভবন, আবাসিক হলসহ বেশ কিছু বাস ভাঙচুর করেন।
স্থানীয়রা জানান, রাত ৩টার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী বিএম কলেজের ভেতরে আটকে পড়েন বলে খবর পাওয়া যায়। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপরও বিএম কলেজের আশপাশে পাল্টাপাল্টি হামলার খবর পাওয়া যায়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, তাসনুভা চৌধুরী জোয়া’র বাড়ি দখল করতে বিরোধী প্রতিবেশী বিএম কলেজের সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া মোস্তাফিজুর রহমান রাফিকে ভাড়া করে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে রাফি ও তার সঙ্গে থাকা লোকজন হামলা চালান।
সেখানে হামলার শিকার হন ববি শিক্ষার্থী জোয়া। খবর পেয়ে সহপাঠীরা ওই রাতেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হামলার কারণ জানতে চান। সেখানে তাদের ওপরও হামলার চেষ্টা করেন রাফি। পরে থানায় জিডি করেন জোয়া।
ববি শিক্ষার্থীরা বলেন, মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে তাদের দুই শিক্ষার্থীকে নগরের বটতলা এলাকায় পেয়ে বেধড়ক মারধর করেন বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ দুই ঘটনায় সংঘর্ষ বাঁধে।
শিক্ষার্থীদের দাবি, ববির পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটকে রাখেন বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা, পাশাপাশি তাদের বাসও ভাঙচুর করা হয়। সশস্ত্র হামলায় তাদের অনেকে আহত হন। এরপর তারা বিএম কলেজে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানান সেনাবাহিনীর কাছে।
বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, বেশ কয়েকদিন ধরে এক নারী বিএম কলেজে এসে সমন্বয়কদের সহায়তা চাচ্ছিলেন তার বাড়ি দখল করা হয়েছে জানিয়ে। সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর রহমান রাফি ওই নারীর বিরোধী প্রতিবেশী পরিবারের সঙ্গে আলোচনার জন্য সেই বাড়িতে যান।
তারা জানান, সেই বাড়িতে যাওয়া মাত্রই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী পরিচয় দেওয়া জোয়া সমন্বয়ককে গালাগাল করেন। পরে ওই ছাত্রী তার বয়ফ্রেন্ডকে (ছেলে বন্ধু) কল করলে তিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস ভর্তি করে শিক্ষার্থীদের ঘটনাস্থলে নিয়ে এসে বিএম কলেজের সমন্বয়ক রাফির ওপর হামলা চালান।
বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি, মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে বটতলা এলাকায় চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে তারা আটক করেন। তাদের আটক করায় ববি শিক্ষার্থীরা বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালান।
তাদের দাবি, বিএম কলেজের তিনটি বাস, প্রশাসনিক ভবন, শ্রেণিকক্ষ ও তিনটি হলে ব্যাপক ভাঙচুর চালান বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা বিএম কলেজ এলাকার দোকানপাটও ভাঙচুর করেন। বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফসল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। এই হামলার জবাব তারা খুব দ্রুতই দেবেন। এ ঘটনায় তাদের প্রায় ৪৫ শিক্ষার্থী আহত হন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. উম্মেষ রায় বলেন, হামলায় আমাদের শতাধিক শিক্ষার্থী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখনো ৩৩ জনের মতো ভর্তি। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়েছেন।
সংঘর্ষের বিষয়ে বিএম কলেজ প্রশাসনের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।