চট্টগ্রামসীতাকুণ্ড

সীতাকুণ্ডে জাহাজে শ্রমিকের মৃত্যু: ওসিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে স্ক্র্যাপ জাহাজে কর্মরত অবস্থায় মো. রাসেল (২৪) নামে এক শ্রমিকের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় থানার সীতাকুণ্ড থানার ওসি, এসআই ও জাহাজের কথিত মালিকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করা হয়েছে।

রবিবার (১ অক্টোবর) চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪ এর বিচারক মাহমুদুল হকের আদালতে বাদী হয়ে মামলাটি গ্রহণের আবেদন করেছেন নিহত জাহাজভাঙা শ্রমিক মো. রাসেলের পিতা মো. ইউনুস মিয়া (৪৮)।

মামলায় সীতাকুণ্ড থানার ওসি, এসআই ও জাহাজ মালিকসহ অন্য ৩ বিবাদীর বিরুদ্ধে হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগ আনা হয়েছে। বিবাদীরা হলেন- এমবি হানিমধু জাহাজের মালিক ও সাউদার্ন স্যালভেজের স্বত্বাধিকারী আসাদুজ্জামান স্বপন (৪৮), মুছাদ্দেক মিয়া (৪২), এনবি হানিমধু জাহাজের শ্রমিকদের ঠিকাদার ফারুক আহম্মদ (৩০), কাটারম্যান এনামুল (২০), সীতাকুণ্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ (৪৮) ও সদ্য বিদায়ী সেকেন্ড অফিসার এসআই মুকিব হাসান (৪২)।

তন্মধ্যে আসাদুজ্জামান স্বপন ও মুছাদ্দেক আপন ভাই। তারা ঢাকার ভাটারা থানার ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের শামসুল হকের ছেলে। তবে তারা সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী শিপব্রেকিংয়ের পাশে পরিত্যক্ত ইয়ার্ডে ব্যবসা পরিচালনা ও বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন শেরশাহ বাংলা বাজার এলাকায় বারাকা ভবনের চতুর্থ তলায় বসবাস করে আসছেন।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, নিহত মো. রাসেল তার পরিবারসহ সীতাকুণ্ডের মাদামবিবিরহাট নেভী রোড় এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। তার বাবা একজন ইউনূস মিয়া একজন দিনমজুর। মো. রাসেল আসাদুজ্জামান স্বপনের স্ক্র্যাপ জাহাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। গত ২৬ আগস্ট সকালে ইয়ার্ডে (ভাটিয়ারী স্টিলের পাশের পরিত্যক্ত ববিতা ফিল্ড) কাজের উদ্দেশ্যে বের হন৷ ওইদিন ঠিকাদার ফারুক, কাটারম্যান এনামুল ও হেলফার মহিউদ্দিন মো. রাসেলকে কাজে নিয়ে যায়।

কিন্তু ওইদিন রাত পর্যন্ত মো. রাসেল বাসায় ফেরেননি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাসেলের পিতা ইউনূস মিয়া জাহাজের মালিক আসাদুজ্জামান স্বপন ও ম্যানেজার মুছাদ্দেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা তাকে জানায় যে বোট নষ্ট হয়ে পড়ায় সবাইকে সাঁতার কেটে যে ফেরীতে খাবারের ব্যবস্থা আছে সেই ফেরীতে যেতে বলা হয়। এসময় সবাই গেলেও ভিকটিম রাসেল যাননি। এতে ম্যানেজার মুছাদ্দেক ও ঠিকাদার ফারুকের সঙ্গে রাসেলের বাকবিতন্ডা হয়।

শ্রমিকদের ভাষ্য মতে, মামলার বাদী ইউনূস মিয়া জানতে পারেন যে একপর্যায়ে বিকাল চারটার দিকে ভিকটিমের হেলফার মহিউদ্দিনকেও সাঁতার কেটে খাবারের ফেরীতে যেতে বাধ্য করা হয়। কিছুক্ষণ পর রনি মিয়া, শাহজাহান ও শিপন নামে তিনজন শ্রমিক চিৎকার করে বলতে থাকেন, ভিকটিম রাসেল পানিতে পড়ে গেছেন।

মামলার বাদীকে বিবাদীরা জানিয়েছেন, অনেক খোঁজাখুঁজির পরও রাসেলকে পাওয়া যায়নি। বাদী আরও জানতে পারেন, পরবর্তীতে মামলার ২ নম্বর বিবাদী মুছাদ্দেক ভিকটিমের হেলফার মহিউদ্দিনকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেয় এবং সারারাত অফিসে বসিয়ে রাখেন। ওই রাতে মহিউদ্দিন বাড়ি যেতে চাইলেও যেতে দেওয়া হয়নি। এমনকি ২৭ আগস্টও মহিউদ্দিনকে বাসায় যেতে দেয়া হয়নি।

২৭ আগস্ট ভিকটিমের পিতা ইউনূস মিয়া তার ছেলের সন্ধান না পেয়ে রাত বারোটার দিকে সীতাকুণ্ড থানায় জিডি করতে যান। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ওইদিন রাতে ইউনূস মিয়াকে থানায় দায়িত্বরত ওসি তোফায়েল আহমেদ ও সেকেন্ড অফিসার মুকিব হাসান ভোররাত ৪টা পর্যন্ত থানায় বসিয়ে রাখেন এবং পরবর্তীতে বলেন জিডি কিংবা অভিযোগ নেওয়া যাবে না। ওইদিন জিডি করতে না পেরে ইউনূস মিয়া ও তার শ্যালক থানা থেকে ফিরে আসে। পরদিন ২৮ আগস্ট ইউনূস মিয়া বিষয়টি মৌখিকভাবে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজিকে জানান।

পরবর্তীতে রাত দশটায় ইউনূস মিয়া সীতাকুণ্ড থানায় গেলে সেকেন্ড অফিসার মুকিব হাসান তার সঙ্গে অশ্লীল ভাষায় কথায় বলেন। অভিযোগ, এসময় সেকেন্ড অফিসার মুকিব হাসান ইউনূসকে উত্তেজিত হয়ে বলেছেন, ডিআইজি আমার কি বাল করবে? আমি যে রিপোর্ট দিব সেটাই হবে। এ বিষয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিব। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, সীতাকুণ্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ বাদী ইউনূস মিয়াকে বলেছেন, এসব নিয়ে মামলা করিও না, আমাদের সমস্যা হবে। জাহাজের মালিককে বলে কিছু টাকা নিয়ে দিব।

মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, মামলার ১ নম্বর বিবাদী আসাদুজ্জামান স্বপন বাদীকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে রাখতে বলেন এবং লাশ পেলে আরও টাকা দেয়ার আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে গত ২ সেপ্টেম্বর রাত দশটায় সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডের ভোলাইপাড়া বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন ভিকটিমের লাশ উদ্ধার করে। ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিকটিমের পিতা ইউনূস মিয়া নিজের ছেলের লাশ সনাক্তের পরও ৬ নম্বর বিবাদী সীতাকুণ্ড থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই মুকিব হাসান ডিএনএ টেস্ট ছাড়া লাশ দেওয়া হবে না জানিয়ে পরবর্তীতে লাশ বুঝিয়ে দেননি। উল্টো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আনজুমানে মফিদুল ইসলামকে দিয়ে লাশ দাফন করে ফেলেন।

পরদিন বাদী ইউনূস মিয়া মামলার ১ নম্বর বিবাদী জাহাজের মালিক আসাদুজ্জামান স্বপনকে বলেন, মুছাদ্দেক ও ফারুক আহমদের যোগসাজশে তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। এসময় আসাদুজ্জামান স্বপন বাদীর সঙ্গে ঔদ্বত্যপূর্ণ আচরণ করেন এবং উল্টো মামলার হুমকি দেন৷ একইভাবে ২ নং বিবাদী মুছাদ্দেকও বাদীকে পরিণতি ভালো হবে না বলে হুমকি প্রদান করে।

এ মামলায় বাদীসহ ৬ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। মামলার বাদী ইউনূস মিয়া একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে এবং ঘটনা ধামাচাপা দিতে লাশ গুম করা হয়েছে। থানায় দৌড়েও কোনও আইনি প্রতিকার পাইনি। ছেলের লাশ শনাক্তের পরও লাশ দেওয়া হয়নি। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে ফেলেছে। উল্টো আমাকে ব্যবসার হাতিয়ার বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। জাহাজের মালিকও বিরূপ আচরণ দেখিয়েছেন। পরিবারের আয়ের অন্যতম ভরসা ছেলেকে হারিয়ে আমার স্ত্রী বাকরুদ্ধ। বিচার পেতে আদালতে মামলা দায়ের করেছি।

বাদী পক্ষের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বলেন, আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে এ সংক্রান্ত কোনো ব্যবস্থা থানায় নেওয়া হয়ে থাকলে তা জানাতে আদেশ দিয়েছেন।

এসব বিষয়ে জানত চাইলে মামলার ১ নম্বর বিবাদী আসাদুজ্জামান স্বপন একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমার নামে মামলার আবেদন হওয়ার কোনো সংবাদ আমি পাইনি। আমার কোনো নিজস্ব ইয়ার্ডও নাই। আমার ইয়ার্ডে কোনো শ্রমিকও মারা যায়নি।

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এণ্ড রিসাইক্লিং এসোসিয়েশনের সচিব নাজমুল হাসান একুশে পত্রিকাকে বলেন, আসাদুজ্জামান স্বপন নামে বিএসবিআরএ’তে কোনো সদস্য নেই। তিনি কোনো ইয়ার্ডের মালিকও না। মূলত বহু বছরের পুরনো একটি জাহাজ পড়ে ছিল সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতে৷ ওই জাহাজ নিয়ে অনেক আইনি জটিলতা রয়েছে। শুনেছি ৭-৮ মাস আগে স্থানীয় কয়েকজন জাহাজটিকে কেটে কুটে নিয়ে যায়। কোনো শ্রমিক নিহতের ঘটনা আমাদের জানা নেই। কোনো জাহাজভাঙা শিল্প মালিকও এটার সাথে জড়িত না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d