বিনোদন

হিমু-তাজিন দুজনের মৃত্যু, দুই স্ত্রীর আত্মহত্যা, কে এই রহস্যময় মিহির?

ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী হুমায়রা হিমুর মৃত্যুতে দেশের মিডিয়াপাড়া বেশ সরগরম। এ মৃত্যুর কারণ জানতে উদগ্রীব মিডিয়াকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ সবাই। ঘটনার তদন্তে প্রেমিক উরফি জিয়াকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। পাশাপাশি আরেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবি উঠেছে শোবিজ অঙ্গন থেকে। সেই ব্যক্তি হলেন মেকআপ আর্টিস্ট মিহির মোহন।

গত বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী হুমায়রা হিমু মারা গেছেন। এ সময় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান মেকআপ আর্টিস্ট মিহির মোহন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পরে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। এর আগে ২০১৮ সালের ২২ মে দুপুর ১২ টার দিকে নিজ উত্তরার বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ। তাকেও হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন মিহির। হাসপাতালে নেওয়ার কিছু সময় পর তার মৃত্যু হয়।

পরবর্তী সময়ে অভিনয় শিল্পী সংঘ জানতে পারে ঘটনাটি সাদামাটা ছিল না। কারণ, তাজিনকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে রেখে কেউ একজন পালিয়ে যায়। জানা যায়, তাজিনের সঙ্গেও সেদিন তাঁর এক বন্ধু ও মিহির ছিলেন। তবে মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানা যায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

তাজিন ও হিমুর এমন অসহায় অনাকাঙ্খিত মৃত্যু নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কেননা কাকতালীয়ভাবে এ দুই অভিনেত্রীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের পাশে ছিলেন মেকআপম্যান মিহির। এমনকি দুজনকে হাসপাতালে নেওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসকের মৃত ঘোষণা পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন মিহির। এককথায় তাদের পুরো মৃত্যুর ঘটনাটি দেখেছেন মেকআপম্যান মিহির।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ মৃত্যুর আগে উত্তরার একটি ফ্ল্যাটে একা থাকতেন। তার মেকআপ আর্টিস্ট ছিলেন এই মিহির। অভিনেত্রীর সঙ্গেই থাকতে দেখা যেত তাকে। তেমনি হুমায়রা হিমুও থাকতেন উত্তরার একটি ফ্ল্যাটে। তার মা মারা যাওয়ার পর মিহিরই তাকে দেখাশোনা করতেন। অভিনেত্রীর বাড়িতেই থাকতেন এই মেকআপম্যান। তবে শেষ সময়ে দুজনেরই পাশে ছিলেন মিহির।

মিডিয়ায় অনেক অভিনেত্রীর আস্থাভাজন মিহির। বিশেষ করে নারী অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক বেশি। অনেকের ধারণা, অভিনেত্রী হিমুর মৃত্যুর সাথে মিহিরের যুক্ততা রয়েছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিল্পী জানান, বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখছি— মিহির নিঃসঙ্গ অভিনয়শিল্পীদের পাশে থাকে। তাদের যে কোনও বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ান। তাজিন ও হিমুর সব তথ্য, জীবনের কষ্ট- সব কিছু মিহির জেনে থাকতে পারে।

জানা যায়, মিহিরের বাড়ি সিলেট। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি মেকআপ আর্টিষ্ট হিসেবে কাজ করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে দুইবার বিয়ে করেছেন। তবে তার দুই স্ত্রী-ই আত্নহত্যা করেছেন বলেও জানা গেছে। এছাড়াও মেকআপ আর্টিস্ট মিহির মিডিয়াপাড়ায় পরিচিত নাম। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ অঙ্গনে কাজ করছেন। মেকআপম্যান হিসেবে তার বেশ নামডাক রয়েছে। তবে একাধিক শিল্পীর ব্যক্তিগত মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।

মিহির সম্পর্কে উপস্থাপক ও অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মেকআপ আর্টিস্ট মিহির একসময় অভিনেত্রী শ্রাবন্তীর ব্যক্তিগত মেকআর্টিস্ট ছিল। আমরা তখন নিয়মিত কাজ করতাম। শ্রাবন্তী তখন প্রথম সারির নায়িকা। শ্রাবন্তী যখন মিহিরকে নিত তখন মিহিরের অনেক দাপট ছিল। শ্রাবন্তীর পরিবর্তনের সাথে সাথে মিহিরেরও অবস্থান পরিবর্তন হয়। তারপর মিহিরকে দেখা যায় তাজিন আপার সঙ্গে।’

তিনি আরও জানান, ‘তাজিন আপার মৃত্যুর ঘটনার সময়ও মিহির ছিল। একইভাবে হুমায়রা হিমুর মৃত্যুর ঘটনায়ও মিহির ছিল।। হিমুর সমস্ত তথ্য, জীবনের যাপনের কষ্ট, সব কিছু মিহির জানে। মিহিরকে ডিবি বা পুলিশের ইন্টারোগেশনে আসা উচিত। তাকে জিজ্ঞাসা করলেই সব তথ্য পাওয়া যাবে এটা কি অপমৃত্যু, না অন্য কিছু।’

অভিনেত্রী দীপা খন্দকার বলেন, ‘তাজিনের বাসায় ছিল মিহির। সে মারা যাওয়ার পরে হোমায়রা হিমুর বাসাতেও সে থাকত। দুজনের মৃত্যু হলো। এটা অবশ্যই মনে একটা প্রশ্ন তৈরি করে। অনেকেই বলছে, হিমুর জীবন যাপন একটু অন্য রকমের ছিল। আমাদের যুক্তি হচ্ছে, একটা মানুষ শৃঙ্খলার বাইরে জীবন যাপন যদি করেও এর মানে এই না যে কারও তাকে মেরে ফেলার অধিকার আছে। মিহির এবং ওর সঙ্গে আরেকজন যে ছিল, শুনেছি সে তার বয়ফ্রেন্ড। এখন যেই হোক না কেন, আমার ভাষ্য, একটা বাসায় দুটো মানুষ ছিল। তাদের উপস্থিতিতে একটা মানুষ আত্মহত্যা করে বসল। দরজা খোলা ছিল, একটা মানুষ বলছেও সুইসাইড করে ফেলবে, অথচ তারা কিছুই দেখতে পেল না। মেয়েটা মরেই গেল। এটা আমার কাছে রিয়েলিস্টিক মনে হচ্ছে না।’

দীপা বলেন, ‘মিহিরকে আমি মেকআপশিল্পী হিসেবেই বেশি পেয়েছি। পারসোনালি খুব একটা মিশিনি। পরিচয় থাকার কারণে সে অনেক সময়ই ফোন করে বলেছে, ভালো নেই, খেতে পায় না। শুনেছি, এটা–ওটার অভ্যাস আছে। বিভিন্ন সময় টাকা ধার চেয়েছে। অনেকেই তো অনেক সময় হেল্প করি, সেভাবেই মিহিরকেও হেল্প করেছি। কিন্তু তাজিন ও হিমুর বাসায় মৃত্যুর আগে থাকাটা সন্দেহজনক, স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বলতে তো পারব না কে দোষী।’ সব শেষে দীপা খন্দকার জানান, মিহিরকে তিনি অনেক দিন থেকেই চেনেন। বিভিন্ন সময় তাঁর কাছ থেকে সহযোগিতাও নিয়েছেন।

এদিকে মৃত্যুর আগে হিমু নিজেকে সবকিছু থেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন অভিনেত্রী তাহমিনা সুলতানা মৌ। মিহিরকে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অতীতের বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে উনার(মিহির) নাম বারবার আসছে। এটা একটু তদন্ত করে দেখা উচিত। আমার তার সঙ্গে তেমন একটা কাজ করা হয়নি। তিনি(মিহির) হিমুর সঙ্গে ক্লোজ ছিলেন, তাজিন আপার সঙ্গে ক্লোজ ছিলেন। আমার মনে হয় তার সঙ্গে কথা বললে জানা যাবে বিষয়টা আসলে কি? যেহেতু তার নাম বারবার উঠে আসছে। বিষয়টি তদন্ত করা উচিত।

এদিকে মেকআপম্যানদের সংগঠন ‘মেকআপ আর্টিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে জানানো হয়, মিহির একবার তাদের সংগঠনের ফরম পূরণ করেছিল কিন্তু পূর্ণ সদস্যপদ গ্রহণ করেনি। এমনকি পরে যোগাযোগও করেননি। তাই মিহির সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।

অভিনেতা রওনক হাসান বলেন, ‘এই আত্মহত্যার ঘটনাটা আমাদের কাছে একটু ধোঁয়াশা তৈরি করছে। এ ছাড়া হিমুর শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। এখন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ছাড়া কিছুই বলা যাবে না।’

অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবীব নাসিম বলেন, ‘হোমায়রা হিমু কিছুদিন কাজ করেননি। কিছুটা বিরতির পর সম্প্রতি সে দু–তিনটা ধারাবাহিকে নাম লিখিয়েছিল। এই বছরের শুরুর দিকে আমাদের শিল্পীদের বড় আয়োজন ছিল। সেখানে তার প্রাণবন্ত উপস্থিতি ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে অনেকেরই যোগাযোগ ছিল। এমন না যে তার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল বা কাজ পাচ্ছিল না। অনেকেই বলছেন, কেউ মারা গেলেই তাকে সবাই স্মরণ করেন, বিষয়টা এমন না। কেউ দূরে থাকলে অন্যদের কী করার আছে?’

হোমায়রা হিমুর বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তাঁর মা–বাবা কেউ বেঁচে নেই। এসব নিয়ে মাঝে মধ্যে তাঁর মধ্যে একাকিত্ব পেয়ে বসত বলে জানান তাঁর সহকর্মীরা। এ জন্য অনেকটা নিজের মতো করেই চলতে পছন্দ করতেন। অনলাইনে তাঁর সক্রিয় থাকা কথা জানা গেছে। কেউ না থাকায় মৃত্যুর পরে তাঁর সব দায়িত্ব পালন করেছেন অভিনয় শিল্পী সংঘ। তখন তারা স্বাভাবিক মৃত্যু মনে করেই পাশে ছিল। কিন্তু এবার মনে সন্দেহ জাগায়।

নাসিম আরও বলেন, ‘এর আগেও একইভাবে তাজিনকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে একজন পালিয়ে যায়। এবারও হিমুকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে একজন পালিয়ে যায়। পরে জানা যায়, তার বাসায় সেই মিহিরই ছিল। এই নিয়ে ঘটনা কী, কীভাবে মৃত্যু হয়েছে, সেটা পোস্টমর্টেম হওয়ার পরেই জানা যাবে। কেউ দায়ী থাকলে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলব। কিন্তু এখন আমরা কোনো কিছু বলতে পারছি না।’

হুমায়ারা হিমুর মামা ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক পরিচালক মঈন উদ্দিন চৌধুরী বলেন, হিমুর বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। হিমু বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা প্রকৌশলী সানা উল্লাহ গত আগস্ট মাসে মারা যান। তার মা শামীম আরা চৌধুরী ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। হিমুর মরদেহ তার মায়ের কবরের পাশেই সমাহিত করা হয়েছে।

অন্যদিকে তাজিন আহমেদের মা দিলারা জলির প্রোডাকশন হাউস ছিল। তার হাত ধরেই মিডিয়ায় যাত্রা শুরু অভিনেত্রীর। দীর্ঘদিন থিয়েটারেও কাজ করেছেন। তার সর্বশেষ অভিনীত মঞ্চ নাটক ‘ময়ূর সিংহাসন’।

ঘটনার দিন হিমুকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান জিয়াউদ্দিন। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ঢাকার বংশাল থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিয়াউদ্দিনের বিষয়ে গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে উঠে আসে, হিমুর সঙ্গে জিয়াউদ্দিনের ৯ বছর ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন। তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত ঝগড়া হতো।

এদিকে, হুমায়রা হিমুকে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলায় গ্রেফতার মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন রুফি ওরফে উরফি জিয়ার কাছ থেকে নানা ধরণের তথ্য পেয়েছে র‍্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হিমুর প্রেমিক উরফি জানিয়েছেন, তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন এবং তাকে মাদক এনে দিতেন হিমুর বাসায় থাকা মিহির।

র‌্যাব বলছে, মিহিরের সঙ্গে মাদকের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও তদন্ত করা হবে। মিহির অন্য অভিনয়শিল্পীদেরও মাদক দেয় কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে। হিমুর প্রকৃত মৃত্যুর রহস্য জানতে তাই আরও তদন্তের প্রয়োজন বলে মনে করেন র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d