জাতীয়রাজনীতি

আ.লীগের পুরো মেয়াদে চলবে দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বর্তমান দুই কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের তথ্য নিয়ে দেশ জুড়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সূত্র ও তার এক উপদেষ্টা বলেছেন, প্রথম ধাপে আগামী ছয় মাসে অন্তত ৪০ জন দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হবে। শুধু আমলা বা বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যই নয়, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

৪০ জনের এ তালিকায় কারা আছেন, সেটি খুঁজে বের করার নানা চেষ্টা করা হলেও বের করা যায়নি। তাছাড়া কারা আছেন সেটি প্রকাশ্যে আসুক, তা কোনোভাবেই চান না এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।

জানা গেছে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে সরকারের পুরো মেয়াদ জুড়ে। আগামী বছর সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান আরও কঠোর হবে। ওই দুটি সূত্র আরও জানায়, সরকারের পাশাপাশি দলকে দুর্নীতিবাজমুক্ত করতে চান প্রধানমন্ত্রী।

সরকার ও দলের একাধিক সূত্র জানায়, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান (পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে বদলি), এনবিআরের প্রথম সচিব (কর) কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের দুর্নীতির তথ্য সামনে নিয়ে আসা দুর্নীতিবিরোধী সরকারের অভিযানেরই অংশ।

তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা মনে করেন, আওয়ামী লীগের ত্যাগের ও আদর্শের রাজনীতির যে ঐতিহ্য ছিল, তা ম্লান করে দিচ্ছেন দুর্নীতিবাজ কিছু রাজনীতিবিদ। এখন তা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আরেকটি সূত্র বলেন, এক দিনে, এক সপ্তাহে বা এক মাসেই দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই সরকারের। কারণ, একসঙ্গে সবাইকে ধরতে গেলে সরকারে অস্থিরতার সৃষ্টি করবে এ বিষয়টিও মাথায় রাখা হয়েছে। সে কারণে ধাপে ধাপে সরকারের মেয়াদ জুড়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালানো হবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ মেয়াদে ‘টপ প্রায়োরিটি’ (সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার) দুর্নীতি সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা। দুর্নীতিবাজদের ধীরে ধীরে নির্মূল করার উদ্যোগ আসবে।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনা শুরু থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো ট্রলারেন্স নীতি অনুসরণ করেন। কখনো কখনো তা ব্যাহত হয়েছে। এ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তিনি মনে করেছেন, দুর্নীতি দমন এখন জনগণের দাবি।

অবশ্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বিভিন্ন পদে থাকা ও তৃণমূলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা সরকার ও দলকে দুর্নীতিবাজমুক্ত করার চলমান অভিযান শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলেও সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, গত ১৫ বছরে অসংখ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন অসম্পূর্ণ থেকেছে। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় দলের ভেতরে বেশ কয়েকটি ‘প্রেশার গ্রুপ’ সৃষ্টি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, এই প্রেশার গ্রুপ দলের জন্য ভালো হবে এমন কাজে যেমন বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার উদ্যোগেও জটিলতার সৃষ্টি করে।

দলের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্যের দাবি, এই ‘প্রেশার গ্রুপের’ সবচেয়ে বড় শক্তি টাকা। তারা বৈধ-অবৈধ উপায়ে টাকা আয় করেছে। এই টাকার শক্তি দিয়েই দল ও সরকারে গেড়ে বসেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কারণে দলের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পর্যায়েও চলে গেছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।

বিদায় বেলায় এ দুর্নীতিই তার সব অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, এমন আশঙ্কা রয়েছে সরকারপ্রধানের। তাই দুর্নীতির লাগাম টানতে আবারও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবার সরকার ও দলের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও নেতাদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

জানা গেছে, দুর্নীতিবাজদের পদপদবি কেড়ে নেওয়া হবে। এমনকি তাদের আধিপত্যে যারা পদপদবি পেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রেও এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া দল থেকে জঞ্জাল দূর করতে এ মেয়াদে আরও কিছু কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতির। তবে সেই পরিকল্পনা ঠিক কী, তা জানা যায়নি।

দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ ফলপ্রসূ করতে দলের বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্যও (এমপি) যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। তবে এসব করতে গিয়ে সরকারে যাতে অস্থিরতা তৈরি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে। সে কারণে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতাও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ধরা পড়তে পারেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৪ সালের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি ‘প্রেশার গ্রুপের’ কবজায় চলে যায়। সরকারের অস্থির সময়কে পুঁজি করে দলে রাজনৈতিক নেতাদের বাদ দিয়ে তাদের অনুসারী বসিয়েছে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনেও রাজনৈতিক নেতাদের বাদ দিয়ে টাকাওয়ালাদের বসিয়েছে। তারা টাকার রাজনীতিকে চাঙ্গা করেছে। আদর্শের-ত্যাগের রাজনীতির চর্চা করা নেতাদের রাজনীতিতে থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এ নেতার দাবি, টাকার রাজনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠায় আওয়ামী লীগে দুর্নীতির সংস্কৃতি চালু হয়েছে।

তিনি বলেন, দলের ত্যাগী রাজনীতিকরাও দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। টাকা হলেই সব পাওয়া যায় এমন একটি ধারণায় দুর্নীতির দিকে ধাবিত হয়েছেন তারা। ফলে ১৫ বছরে সারা দেশেই সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ক্ষমতায় থাকায় সারা দেশে সংগঠনের দুর্বল চিত্র টের পাওয়া যাচ্ছে না। অনুধাবন করা যাচ্ছে না।

সংগঠনের দুর্বল চিত্রের উদাহরণ টেনে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, গত ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় নেতাকর্মীদের যে উপস্থিতি দেখা গেছে, সেটি সাংগঠনিক দুরবস্থার ইঙ্গিত বহন করে।

তার দাবি, এসব অনুষ্ঠান করতে গেলে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ঘটবে কি না, সে ব্যাপারে চিন্তিত থাকতে হয় আয়োজকদের। তাছাড়া, সারা দেশে দলের অভ্যন্তরে দলাদলি, বিশৃঙ্খলা ও মারামারিও দলের দুর্বলতার চিত্র জানান দেয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, সারা দেশেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে অসম রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অসম করে তুলেছেন টাকাওয়ালা রাজনীতিকরা। তারা আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের ভয় পান। তাদের ‘দমনের’ রাজনীতি করেন এই টাকাওয়ালা নেতারা। তিনি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে নেওয়া অবস্থান আওয়ামী লীগকে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি দেবে।

শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের দুই প্রবীণ নেতা বলেন, দুর্নীতিবিরোধী জনমত সৃষ্টি হয়েছে। এ জনমত ক্যাশ করতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। সরকারপ্রধান ও দলীয় সভাপতি মনে করেন, সরকারের এ মেয়াদে দুর্নীতির লাগাম টানাই অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত।

এ দুই নেতা আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের যে উন্নয়ন ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি অর্জনের চেষ্টা, তা বিসর্জন দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না বলে মনে করছেন। আগে নানা নড়বড়ে পরিস্থিতির কারণে দুর্নীতির লাগাম টানতে অপারগ হলেও এবার ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী আর ছাড় না দেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। যত বৈরী পরিস্থিতিই তৈরি হোক না কেন, দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অবস্থান থেকে সরবেন না, এমন মনোভাব সরকারপ্রধানের।

তারা বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো ট্রলারেন্স নীতি’ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় দফায় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিলেও ২০১৪ সালের পর কিছুটা গা-ছাড়া ছিল সরকার। যে কারণে দুর্নীতি লাগামহীন হয়ে গেছে এবং সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘এ মেয়াদে দল আরও জনগণ সম্পৃক্ত হবে। সরকারও দেশের ও জনগণের উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করবে।’ তিনি বলেন, প্রশ্নাতীত কিছু উদ্যোগ দৃশ্যমান হবে আগামীতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d