ইউরোপবাসীর উদ্দেশে এক ফিলিস্তিনির খোলা চিঠি
প্রিয় ইউরোপবাসী, লাখো ফিলিস্তিনির মতো আমিও ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি-না জানি আবার কখন আমাদের নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। এটি এমন একটি বিষয়, যাকে আপনারা সাধারণভাবে ‘ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি’ বলে উল্লেখ করছেন।
আমি যখন এসব কথা লিখছি, তখন আল–আহলি আল–আরাবি হাসপাতালে বোমা হামলায় কয়েক শ শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়েছেন। এসব মানুষ নিরাপদ আশ্রয় ভেবে ওই হাসপাতালকে বেছে নিয়েছিলেন। এর কয়েক ঘণ্টা আগেই পেলাম আমার বন্ধু মোহাম্মেদ মোখিয়েমার, তাঁর স্ত্রী সাফা এবং তাঁদের তিন মাস বয়সী শিশুসন্তান এলিয়ানার মৃত্যু সংবাদ।
ইসরায়েলিদের নির্দেশ মেনে তাঁরা অন্যান্য পরিবারের সঙ্গে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে সরে গিয়েছিলেন। তারপরও তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। ইসরায়েলের চালানো ওই বিমান হামলায় তাঁরাসহ আরও ৭০ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন।
এই মুহূর্তে আমার যে অনুভূতি, তা শুধু আরবি ‘কহর’ (অভিশাপ) শব্দটি দিয়ে কিছুটা বোঝাতে পারব। এ শুধু বেদনা নয়, নিদারুণ যন্ত্রণা আর ক্ষোভের অনুভূতি। ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে জাতিগত নিধন, গণহারে হত্যা, অবিচার, দমনপীড়ন, উপনিবেশ স্থাপন, দখলদারি এবং জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত অনুভূতি এটি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই অনুভূতি ছড়িয়ে আছে। প্রতিটি ফিলিস্তিনির মজ্জায় মজ্জায় এ অনুভূতি গেঁথে আছে।
এটি এমন এক অনুভূতি যাকে সঙ্গী করে আমাদের পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে হয়।শৈশবের স্মৃতি
গাজা উপত্যকায় একটি শরণার্থী পরিবারে জন্মসূত্রে এ বোধটুকু আমার মধ্যেও আছে। আমার দাদা-দাদি ইসদুদ গ্রাম (বর্তমান আশদদ) এবং বায়িত জিরজা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁরা ঘর ছেড়ে জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের বাড়ি থেকে শরণার্থীশিবিরের দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার। ‘কহর’ সম্ভবত আমার শৈশবে মায়ের মুখে দেখা প্রথম আবেগ-অনুভূতির চিহ্ন। প্রথম ইন্তিফাদার সময় গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের সময় আমার তরুণ বয়সী মা তাঁর শিশুসন্তানদের বাঁচানোর চেষ্টায় মরিয়া ছিলেন।
আমার কহরের অনুভূতি হয়েছে তখন, যখন ইসরায়েলিরা প্রথম আমাদের বাড়িতে অভিযান চালাল, যখন প্রথম আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করল, তাঁকে বিনা বিচারে ও বিনা অভিযোগে বারবারই আটক করা হয়েছিল। শান্তিপূর্ণ ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর ইসরায়েলি সেনারা যখন গুলি চালান, তখন আমার মন কহরে ভরে উঠেছিল। নিজে গুলিবিদ্ধ হয়ে যে যন্ত্রণা অনুভূত হয়েছিল, তার চেয়েও কহরের অনুভূতি কঠিন।
২০০৮, ২০০৯, ২০১২, ২০১৪, ২০২০ এবং ২০২১ সালে গাজায় ইসরায়েল যত হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে; অঙ্গচ্ছেদ করেছে; আমার পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা দিয়েই কহরকে সংজ্ঞায়িত করা যায়।ইউরোপীয় নেতাদের দ্বিচারিতা
আজ আমি আমার দেশে যা কিছু হতে দেখছি, তাতে আমার কহরের অনুভূতি হয়। গভীর ক্ষোভ আর হতাশাও হয়। প্রিয় ইউরোপবাসী, যা কিছু চলছে, তা নিয়ে আপনাদের নেতারা যে ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাতে আবারও তাঁদের নৈতিক ব্যর্থতা এবং দ্বৈত আচরণ প্রকাশ পেয়েছে।
১১ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন দের লেয়েন ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ইউরোপ ইসরায়েলের পাশে আছে। আমরা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে পূর্ণ সমর্থন দিই।’ গাজাকে যে ইসরায়েল পুরোপুরি অবরোধ করে রেখেছে, বিদ্যুৎ সংযোগ, পানি, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে—আইনবিশেষজ্ঞরা যাঁকে যুদ্ধাপরাধ আখ্যা দিয়েছেন, সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।
মাত্র কয়েক দিন আগে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্টের সহকর্মী কমিশনার অলিভার ভারহেলি ফিলিস্তিনি জনগণকে সব ধরনের সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, যার অর্থ গণহারে নির্বিচার সাজা দেওয়া। অলিভার বলেন, ‘ইসরায়েল ও দেশটির জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও নৃশংসতার মাত্রাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।’ সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্ত পরে প্রত্যাহার করা হলেও যা ক্ষতি হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে। সব ফিলিস্তিনি ‘নৃশংস সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা পেয়েছে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনিদের ‘পশু’ এবং ‘অর্ধ–মানব’ বলে যাচ্ছেতাই বলছেন এবং এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছেন। আর সে ব্যাপারে ইউরোপের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। আরও হতবাক করা বিষয় হচ্ছে, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ‘আরবদের হত্যা কর’ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করলেও কখনো সেটার নিন্দা জানানো হয়নি।
প্রবাসী ফিলিস্তিনি ও তাদের ইউরোপীয় বন্ধুদের গাজার জনগণের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ থেকে বিরত রাখতে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্র প্রতিবাদ-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং পুলিশ বাহিনী বিক্ষোভকারীদের হয়রানি ও মারধর করছে।
ইউরোপের বিভিন্ন দলের রাজনীতিকেরা ফিলিস্তিনিদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অথচ একই রাজনীতিকেরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনীয়দের সমর্থন দিচ্ছে।
তাঁদের আচরণটা এমন যে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ করার অধিকার আছে, ফিলিস্তিনিদের নেই। ইউক্রেনীয়রা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ আর ফিলিস্তিনিরা ‘সন্ত্রাসী’। বেসামরিক বাড়িঘর আর অবকাঠামোর ওপর নির্বিচারে চালানো বোমা হামলায় ইউক্রেনীয়দের প্রাণহানির ঘটনা অত্যন্ত শোকের। অথচ একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রাণ হারানোর ঘটনা তারা এড়িয়ে যায়। অথবা একে তারা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে আখ্যা দেয়। ইউরোপীয়দের এমন দ্বৈত আচরণ সত্যিকার অর্থে ভয়াবহ।
নিজেদের নৈতিকভাবে উচ্চ অবস্থানসম্পন্ন বলে দাবি করা ইউরোপীয় নেতা এবং রাজনীতিকেরা ফিলিস্তিনিদের ‘নৃশংস সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়েছেন।
ইতিহাসে ইউরোপীয়দের স্থান কোথায়
প্রিয় ইউরোপবাসী, ইউরোপের খ্রিষ্টানেরা নিজেদের দোষী মনে করার এ অনুভূতি ৭৫ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর যেসব কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কি আপনারা নিজেদের কখনো দোষী মনে করেছেন?
ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যে নৃশংস আচরণ করা হচ্ছে, তা অনুভব করাটা কঠিন কিছু নয়। নিজেরাই নিজেদের জিজ্ঞাসা করুন, এটা ঠিক হচ্ছে কি না। ইতিহাসের বই খুলে তা পড়ে ফিলিস্তিনে কী ঘটছে, তা জানতে হবে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার লড়াই সম্পর্কে বুঝতে হবে—বিষয়টা এতটা কঠিন হওয়ার কথা নয়। এটা এমন কোনো কঠিন বিষয় নয় যে আমাদের অধিকার রক্ষার পক্ষে জাতিসংঘের দেওয়া অসংখ্য সমাধান প্রস্তাব পড়তে হবে।
মানবাধিকার, সমতা এবং গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলে কোনো দেশের (বিদ্বেষী ও দখলদার) নৃশংস কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ না করতে পারাটা লজ্জার।যুদ্ধের প্রথম ছয় দিনে ঘনবসতিপূর্ণ গাজা উপত্যকায় ছয় হাজার বোমা ফেলেছে ইসরায়েল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি আণবিক বোমার এক–চতুর্থাংশের সমতুল্য। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, হামলায় তিন হাজারের (যুদ্ধের ১২তম দিন) বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। তবে বাস্তবতা হলো, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা কত, তা আমরা এখনো নিশ্চিত নই। অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছে, যাদের বের করে আনার কেউ নেই।
গত সপ্তাহে অবিরাম বোমা হামলার মধ্যে গাজা থেকে ১১ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে নিরাপদে সরে যাওয়ার আদেশ দেয় ইসরায়েল। ছবিতে যেভাবে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ছেড়ে ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে দেখা গেছে, তা আমাদের নাকবার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছে।
এর মধ্যে আমার পরিবারের সদস্যরাও আছেন। যে বাড়িতে তারা সারা জীবন কাটিয়েছেন, সে বাড়ি হামলায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
যেকোনো মুহূর্তে পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত্যুর খবর পাওয়ার আশঙ্কা নিয়েই আমি এ কথাগুলো লিখছি। আমার পরিবারে আছে বাবা ইসমাইল, মা হালিমা, ভাই মোহাম্মেদ, ভাবী আসমা এবং আমার দুই ফুটফুটে ভাতিজি এলিয়া (৬ বছর) এবং নায়া (২ মাস)।
আমার চাওয়া, আপনারা নামগুলো মনে রাখুন। আমি চাই না, তাদের নিছকই নিহত হওয়ার সংখ্যা হিসেবে উপস্থাপন করা হোক। এখন আর আমি তাদের প্রাণের ভয় করি না।
প্রিয় ইউরোপবাসী, হয়তো আপনাদের মতামত নেওয়া হয়নি। কিন্তু আপনাদের নির্বাচিত ইউরোপীয় সরকারগুলো ইসরায়েলের অপরাধের ব্যাপারে নীরব রয়েছে। তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমর্থন দিচ্ছে।
এমন এক দিন আসবে যখন ফিলিস্তিন মুক্ত হবে। তখন হিসাব চোকাতে হবে। আপনাদের কাছে জানতে চাওয়া হবে, ইসরায়েলিরা যখন ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে দখলদারি আর বিদ্বেষমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন, তখন আপনারা কী করছিলেন। নিজেদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার জন্য তখন আপনারা কী জবাব দেবেন?
এখনো সময় আছে। ইতিহাসের ভুল জায়গায় অবস্থানের লজ্জা থেকে নিজেদের বাঁচান। বেল হুকস (মার্কিন লেখক) যেমনটা বলেছেন, ‘সংহতি প্রকাশ করেও সক্রিয় থাকা যায়।’
গাজায় নিধনযজ্ঞ বন্ধ করতে আপনারা কি এখন সক্রিয় হবেন?
● অনুবাদ: ফাহমিদা আক্তার