ধর্ম

ইবরাহিম আ.-কে আল্লাহ যেসব পরীক্ষা করেছিলেন

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে বলা হয় মুসলিম জাতির পিতা। তিনি ছিলেন হজরত নূহ আলাইহিস সালামের সম্ভবত: এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ থেকে ইবরাহীম পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল। হজরত সালেহ আলাইহিস সালামের প্রায় ২০০ বছর পরে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আগমন ঘটে।

ইবরাহিম আলাইহিস সালামের পরবর্তী সকল নবী তার বংশধর ছিলেন। তার ছেলে ইসহাক আলাইহিস সালাম থেকে বনী ইসরাঈলের সূচনা। ইসহাক আ.-এর পুত্র ইয়াকুব আ. থেকে বনী ইসরাঈলের বিস্তার ঘটে।

অপর দিকে হজরত ইবরাহিম আ.-এর আরেক ছেলে ইসামাঈল আ.-এর বংশে জন্ম নিয়েছেন সাইয়্যিদুনা হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যাকে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে আগমনকারী সকল মানুষের হেদায়েতের জন্য নির্বাচন করেছেন এবং তাকে খাতামুন্নাবীয়্যিন বা সর্বশেষ নবী হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

ইবরাহিম আ.-কে আল্লাহ তায়ালা বেশ কিছু পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি প্রত্যেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালার খলিল বা খলিলুল্লাহ উপাধি পেয়েছেন।

ইবরাহিম আলাইহিস সালাম জীবনে যেসব পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন, তা হলো—

মূর্তিপূজার পরিবেশে বেড়ে ওঠা

ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা নবী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। তবে তার জীবনের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল শৈশব বা বেড়ে ওঠার সময়কাল থেকেই। তিনি যেই পরিবেশে বড় হয়েছিলেন, সেখানে সবাই ছিল আল্লাহ বিমুখ। আল্লাহর নাফরমানী ও মূর্তিপূজাই ছিল তাদের মূল ইবাদত।

কিন্তু নবী ইবরাহিম আলাইহিস সালাম শৈশব থেকেই এসব থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলেন। মানুষের নিজ হাতে তৈরি মূর্তিপূজা নিয়ে তার মনে শৈশবেই প্রশ্ন জেগেছিল। তিনি ভাবতেন, এ-আবার কেমন রব, যে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। যাকে অন্যরা তৈরি করেছে কাদা-মাটি থেকে। সে নিজেকে মশা-মাছি থেকে রক্ষা করতে পারে না!

তিনি রাতের বেলা চাঁদের আলো দেখে ভাবতেন, এই বুঝি আমাদের রব, এর রশ্মি পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করেছে। সকালে চাঁদ অস্ত গিয়ে সূর্য উঠার পর তিনি ভাবতেন, সূর্যই হয়তো বিশ্বজগতের রব। সূর্যের আলো চাঁদের থেকেও উজ্জ্বল। কিন্তু সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যাওয়ার পর তার ভাবনা পরিবর্তন হতো। তিনি ভাবতেন, এই সূর্যও আমাদের রব হওয়ার ক্ষমতা রাখে না। সে নিজেও তো অস্ত যায়! নিশ্চয় এমন কেউ আছেন যিনি এই পুরো জগতকে পরিচালনা করছেন এবং সবকিছু তার আদেশ মেনে চলছে।

এভাবেই একটি খোদাবিরোধী পরিবেশে বেড়ে উঠেও আল্লাহ তায়ালার পরিচয় খুঁজে পেয়েছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম।

মূর্তির বিরোধিতা

আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম আ.-কে তার জাতির হেদায়েতের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন। ইবারাহিম আ. নিজ সম্প্রদায়, মা-বাবা সবাইকে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান করলেন। কিন্তু তারা তার কথা মানলো না, নাফরমানিতে লিপ্ত থাকলো।

ইবরাহিম আ. তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন, যেই মূর্তিকে অন্য কেউ তৈরি করে এবং যে নিজের গায়ে বসা ক্ষুদ্র মাছিও সরাতে পারে না, সে কীভাবে মানুষের খোদা হয়! কিন্তু তারা কেউ তার কথা মানলো না।

একদিন ইবরাহিম আ.-এর সম্প্রদায়ের লোকজন এক মেলায় গেল। এই সময় তিনি তাদের মূর্তিপূর্জার অসাড়তা বোঝানোর জন্য মূর্তিগুলো ভেঙে ফেললেন। সম্প্রদায়ের লোকজন ফিরে এসে যখন মূর্তিগুলোকে ভাঙা দেখতে পেলো। তারা বললো, নিশ্চয় ইবরাহিম এই কাজ করেছে। সে সবসময় আমাদের মূর্তির বিরুদ্ধে কথা বলে।

নমরুদ কর্তৃক আগুনে নিক্ষেপ

এসব দেখে তারা রেগে গেল এবং ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে এমন শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, যার পর আর কেউ যেন মূর্তির বিরোধিতার সাহস না করে।

ইবরাহিম আলাইহিস সালামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তারা তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান নমরুদের ওপর ছেড়ে দিল। নমরুদ ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিল। বিশাল অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দেওয়া হলো ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে সেই আগুন খলিলুল্লাহ ইবরাহিম আ.-এর জন্য প্রশান্তির জায়গায় পরিণত হলো।

স্ত্রী সন্তানকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে আসার আদেশ

এরপর নিজ সম্প্রদায়ের লোকজনের থেকে হিজরত করে তিনি শাম বা সিরিয়ার অন্তর্গত বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অদূরে কেনআন নামক স্থানে হিজরত করেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী হাজেরার গর্ভ থেকে সন্তান হিসেবে হজরত ইসলাঈল আলাইহিস সালামকে দান করেন।

পুত্র সন্তানের পিতা হওয়ার পর আরেক মহান পরীক্ষার সম্মুখীন হন তিনি। আল্লাহ তায়ালা তার স্ত্রী ও দুধের শিশুকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে আসার নির্দেশ দেন। আল্লাহর আদেশে তিনি স্ত্রী-সন্তানকে বর্তমানে মক্কা নগরীর জায়গায় রেখে আসেন। রেখে আসার সময় তাদের কাছে একেবারে সামান্য কিছু খাবার ছিল। যা দুয়েক দিনেই শেষ হয়ে যায়।

শিশু ইসমাঈল আ. ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে উঠলে আল্লাহ তায়ালা তার পায়ের আঘাত থেকে জমজম কূপ সৃষ্টি করেন। যার বরকতময় পানি পান করে এখনো পিপাসা মেটান পুরো বিশ্বের মানুষেরা।

প্রিয় ছেলে ইসমাঈলকে জবেহের আদেশ

স্ত্রী-সন্তানকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে আসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে জীবনের আরেক মহান পরীক্ষার মুখোমুখি করলেন। যখন তার ছেলে ইসমাঈল কিছুটা বড় হলো, তার সঙ্গে চলাফেরার মতো বয়সে উপনীত হলো, এ সময় তাকে স্বপ্নে দেখানো হলো, হে ইবরাহিম! তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি করো।

আদেশ পেয়ে তিনি উট কোরবানি করলেন। কিন্তু এরপরও তাকে আবারো স্বপ্নে একই আদেশ দেওয়া হলো। তিনি আবারো উট কোরবানি করলেন। তাকে আবারো একই আদেশ দেওয়া হলো।

কয়েক দফা একই আদেশের পর তিনি বুঝলেন, বর্তমানে তার সবথেকে প্রিয় বস্তু হলো তার ছেলে ইসমাঈল। এটা বুঝতে পারার পর তিনি ছেলেকে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করে মিনা প্রান্তরে নিয়ে গেলেন। কোরবানির সব আয়োজন সম্পন্ন করার পর আল্লাহ তায়ালা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে জান্নাত থেকে একটি দুম্বা পাঠালেন এবং ইসমাঈল আলাইহিস সালামের পরিবর্তে সেই দুম্বা কোরবানি করা হলো। একইসঙ্গে ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে সুসংবাদ দেওয়া হলো যে, তিনি আল্লাহ তায়ালার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।

পবিত্র কোরআনে বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে—

‘তারা দুইজনই (পিতা-পুত্র) আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে (জবাই করার জন্য) কাত করে শুইয়ে দিলো, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্য প্রমাণ করেছ, নিঃসন্দেহে আমি সৎকর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কার দিয়ে থাকি। এটা ছিল তাদের উভয়ের জন্য একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি ছেলের পরিবর্তে একটি বড় কোরবানির জন্তু তাকে দান করলাম। (অনাগত মানুষদের মাঝে এভাবেই) তাঁর স্মরণকে আমি অব্যাহত রেখে দিলাম।’ (সূরা আস-সাফফাত, (৩৭), আয়াত : ১০৩-১০৮)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d