চট্টগ্রাম

এনআইডি সেবা : বিশেষ কমিটির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হচ্ছে চট্টগ্রামবাসী

চট্টগ্রাম অঞ্চলে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা পেতে দেশের নাগরিকদের এক কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এতে স্বদেশী হয়েও পরিচয় প্রমাণে হেন কোনো দলিল নেই যা দাখিল করতে না হয়।

ফলে ভোগান্তির কোনো শেষ থাকে না। তাই চট্টগ্রামবাসীকে ‘বিশেষ কমিটির’ বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভোটার নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ এলাকার যেসব নাগরিকের একাডেমিক সনদ বা বৈধ কাগজপত্র আছে তাদেরকে সন্দেহভাজন রোহিঙ্গাদের মতো একই ক্যাটাগরিতে না ফেলে তাদের ভোটার নিবন্ধন সহজ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে। এ জন্য আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে সুপারিশসহ ২ (দুই) সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলে কমিশন।

আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সেই নির্দেশনার আলোকে ১৬ দফা সুপারিশ করেছে ইসিকে। তবে সে সব সুপারিশ আমলে নিয়ে মূলত তিনটি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সংস্থাটি। প্রথমত, আবেদন এলেই রোহিঙ্গা সন্দেহ নয়, দ্বিতীয়ত, তিনটি ক্যাটাগরিতে আবেদন ভাগ করা, তৃতীয়ত বয়স্কদের মধ্যে যেসব আবেদনকারীর পিতা, মাতা বেঁচে নেই তাদের আবেদন বিশেষ কমিটির মাধ্যমে নিষ্পত্তিকরণ।

জানা গেছে, রোহিঙ্গারা সমতলে ছড়িয়ে পড়ায় ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশন চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৩২টি উপজেলা/থানাকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করে ইসি। ওই ৩২টি উপজেলা/থানার ভোটারযোগ্য ব্যক্তিদের নিবন্ধনের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ‘বিশেষ কমিটি’ গঠন করা হয়। ওই কমিটির যাচাই-বাছাই এবং সুপারিশ প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়।

বিশেষ এলাকাগুলো হলো- কক্সবাজার সদর উপজেলা, চকোরিয়া, টেকনাফ, রামু, পেকুয়া, উখিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া। বান্দরবানের সদর, রুমা, থানচি, বোয়াংছড়ি, আলীকদম, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা।

এছাড়াও রাঙামাটির সদর, লংগদু, রাজস্থলী, বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল এবং চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগড়া, বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া ও কর্ণফুলী উপজেলাকে বিশেষ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এসব এলাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আহ্বায়ক ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে গঠিত ১৫ সদস্যের বিশেষ কমিটির কাজও নির্ধারণ করে দিয়েছিল ইসি।

কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষে কমিটির মাধ্যমে ভোটার হতে গেলে ভাই-বোন, পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, মামা, ফুফু, খালা ইত্যাদির তথ্য; বাড়ির জমির দলিলসহ বিভিন্ন ধরণের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়। এতে রোহিঙ্গা বা ভিনদেশিদের কারণে দেশের নাগরিকদেরও সেবা প্রাপ্তি কঠিন হয়ে যায়৷ তাই এখন থেকে সব আবেদন বিশেষ কমিটিতে না নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এতে সমতলের মতোই অধিকাংশ আবেদন নিষ্পত্তি হবে।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ এ বিষয়ে বলেন, আমরা কয়েকটি সুপারিশ রাখবো। আর এটা কমিশন অনুমোদন দেবে। বাংলাদেশে যারা ওয়ান থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে, এদেশে জন্ম নিয়েছে, তারা সমতলের মতো আমল যোগ্য হবেন। সোজা হিসাব।

তিনি বলেন, আমরা আলোচনায় রেখেছি, তিনটা ক্যাটাগরির আবেদন থাকবে। ক, খ ও গ। শুধু গ ক্যাটাগরির যেটা থাকবে, ৩৯ শতাংশ আবেদন বিশেষ কমিটিতে যাবে। আর সব সমতলের মতো হবে। ৭০ শতাংশ আবেদন এমনিতেই নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। আবেদন পাওয়ার পর প্রথমে বাছাই হবে। যারা এই দেশে পড়াশোনা করেছেন, জন্ম নিয়েছেন, বাবা-মা সরকারি চাকরি করে বা বাংলাদেশেই আছে, এনআইডি আছে, তার ভাই বোনের সব এনআইডি আছে, তারা এই সমতলের মতোই হবে৷

অনলি সি (গ) ক্যাটাগরির যারা, তাদের আবেদন বিশেষ কমিটিতে যাবে৷ যারা বয়স্ক এবং যাদের বাবা মা বেঁচে নেই, এগুলো বিশেষ কমিটিতে যাবে। এখন কমিশন এটা অনুমোদন দিলে সেভাবে হবে।

১৬ সুপারিশ:

১) অনলাইন ভেরিফায়েবল বা কিউআর কোড যুক্ত জন্মসনদ, ছবি সম্বলিত নাগরিক সনদ, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে (শিক্ষা সনদ, ওয়ারিশ সনদ, বিবাহ সনদ (সকল ধর্ম/বর্ণ/ জাতিগোষ্ঠী), প্রত্যয়নপত্র, পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রীর এনআইডি ও মৃত্যু সনদ) দাখিল সাপেক্ষে রেজিস্ট্রেশন অফিসারের কাছে সন্তোষজনক বিবেচিত হলে সাধারণ এলাকার ন্যায় ভোটার নিবন্ধন করা যেতে পারে। তবে রেজিস্ট্রেশন অফিসারের কাছে কোনো ভোটার সন্দেহজনক মনে হলে বা উল্লেখিত কাগজপত্র দাখিলে ব্যর্থ হলে বিশেষ কমিটির মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

২) বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশে বসবাসরত ভিনদেশি নাগরিকদের পূর্ণাঙ্গ বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ তৈরি করা এবং ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রমে ক্রসচেক করার ব্যবস্থা করা।

৩) ইউনিয়ন, পৌরসভা/ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড ভিত্তিক স্থায়ীভাবে তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজার নিয়োগের ব্যবস্থা করা।

৪) বিশেষ এলাকায় হালনাগাদের সময়ে নিবন্ধন ফরম ও বিশেষ তথ্য ফরম-২ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পর্যাপ্ত সময় বৃদ্ধির পাশাপাশি নিবন্ধন ফরমের সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন তথ্য ও দলিলাদি যাচাইয়ের জন্য প্রতিটি উপজেলায় হালনাগাদকালীন সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ এবং তাদের সম্মানীর ব্যবস্থা রাখা।

৫) ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি সহজীকরণের বিদ্যমান বিশেষ কমিটির সদস্য সংখ্যা কমিয়ে কমিটি পুনর্গঠন করা। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক প্রতি মাসে যেন কমিটির দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয় সে বিষয়টি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশনা প্রদান করা।

৬) বিশেষ এলাকা/ পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিহীন নাগরিকদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে ভূমি অফিস হতে অনলাইন ভেরিফায়েবল বা কিউআর কোড সম্বলিত ভূমিহীন সনদ সরবারহ করা এবং পার্বত্য অঞ্চলের যেসব উপজেলায় ভূমি অফিস নেই সে সকল উপজেলায় ভূমিহীন সনদ সরবরাহের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করা।

৮) ভূমিহীন নাগরিকগণের স্থায়ী ঠিকানা প্রদানের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয় বিধায় এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা।

৮) বিশেষ এলাকার ক্ষেত্রে কার্ড ম্যানেজমেন্ট পোর্টালে বিদ্যমান ব্যবস্থার পাশাপাশি অতিরিক্ত দলিলাদি সংযুক্তির ব্যবস্থা রাখা।

৯) অনলাইন ভেরিফায়েবল বা কিউআর কোড সম্বলিত দলিলাদি সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদান করা।

১০) বাংলাদেশি নাগরিকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া রোহিঙ্গা/ভিনদেশি নাগরিক এবং তাদের সন্তান-সন্ততির ভোটার নিবন্ধনের বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা।

১১) ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য বিশেষ এলাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের প্রমাণ স্বরুপ কোনো কোনো দলিলাদি প্রয়োজন সে বিষয়ে পরিপত্র জারি করা।

১২) বিশেষ এলাকার ভোটার তালিকায় অর্ন্তভূক্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনপ্রতিনিধি ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা।

১৩) বিশেষ কমিটির সভা ও ভোটার তালিকা হালনাগাদের ফরমসমূহ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উপজেলা নির্বাচন অফিসে টিনশেডের একটি সেমিনার কক্ষ নির্মাণ করা যেতে পারে। এতে ভেন্যু জটিলতা নিরসন হবে।

১৪) রেজিস্ট্রেশন অফিসার/বিশেষ কমিটির নিকট সন্দেহজনক আবেদনসমূহ তদন্তকারী সংস্থা ডিএসবি/ কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে বিশেষ কমিটির নিকটনপ্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশনা প্রদান করা।

১৫) বিশেষ কমিটির সদস্যদের জন্য আপ্যায়ন ভাতা এবং সম্মানি/যাতায়াত ভাতা প্রদানে ব্যবস্থা করা।

১৬) উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরবরাহকৃত অনলাইন জন্মসনদ, জাতীয়তা/নাগরিক সনদ, প্রত্যয়নপত্র, শিক্ষা সনদ, পাসপোর্ট, ইত্যাদির ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তিকে ভোটার তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করা হলে পরবর্তীতে রোহিঙ্গা/ভিনদেশি নাগরিক হিসেবে অভিযোগ উত্থাপিত হলে তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট দলিলাদি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের উপর বর্তাবে। এক্ষেত্রে ভুয়া দলিল দাখিলকারী ও প্রস্তুতকারী ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d