এবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘ভয়ংকর’ হওয়ার শঙ্কা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আর এর বিস্তৃতি ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। চলতি বছরেও একই চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া না হলে গতবছরের মতো এবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে বলে শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে দুই হাজার ৬৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯২৩ জন ঢাকার এবং এক হাজার ৭৬০ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। অর্থাৎ মোট আক্রান্তের ৬৫ দশমিক ৫৯৮ শতাংশই রাজধানীর বাইরে।
ঢাকা মহানগরের বাইরে সর্বোচ্চ ২০৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে চাঁদপুরে। জেলাটির সিভিল সার্জন সূত্রে জানা গেছে, চাঁদপুরে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২০৮ ডেঙ্গু রোগী জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত বছরে একই সময়ে এ জেলায় চিকিৎসা নেওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৮ জন। অর্থাৎ চাঁদপুরে এ বছর ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে ২৫ গুণের বেশি।
আক্রান্তের দিক থেকে পরের অবস্থান বরগুনার। জেলাটিতে এখন পর্যন্ত ১৫৪ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজারে ১৪৯, চট্টগ্রামে ১৪৭, বরিশালে ১১৪, নরসিংদীতে ১১১, কুমিল্লায় ১০০, লক্ষীপুরে ৬১, পিরোজপুরে ৫৮, মাদারীপুরে ৫৭, শরীয়তপুরে ৪৪ এবং ময়মনসিংহে ৩২ জনের মশাবহিত রোগটি শনাক্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৪২৯ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ২৩ হাজার ৬১৭ জন এবং ঢাকা বাইরে ৪ হাজার ৮১২ জন। ওই বছর মৃত্যু হয়েছিল ১০৫ জনের। এর মধ্যে ঢাকায় ৯৫ জন, ঢাকার বাইরে ১০ জন। শতকরা হিসেবে ঢাকার বাইরে রোগী ছিল ১৬ দশমিক ৯২ শতাংশ, মৃত্যু ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।
২০২২ সালে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৯ হাজার ২২০ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৩ হাজার ১৬২ জন। সে বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল ২৮১ জনের। যার মধ্যে ঢাকায় ১৭৩ জন এবং ঢাকার বাইরে ১০ জন। ঢাকার বাইরে রোগী ছিল ৩৭ দশমিক ১২ শতাংশ এবং মৃত্যু ৩৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
২০২৩ সালে অতীতের সব রেকর্ড ভাঙে ডেঙ্গু। গত বছর ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ২ লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। বছরটিতে মৃত্যু হয়েছিল ১ হাজার ৭০৫ জনের। এর মধ্যে ঢাকায় ৯৮০ জন এবং ঢাকার বাইরে ৭২৫ জন। গেল এই বছরে ঢাকার বাইরে রোগী ছিল ৬৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর মৃতের হারে ছিল ৪২ দশমিক ৫২ শতাংশ।
এমন অবস্থায় রাজধানীর পাশাপাশি সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় সকল প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরেও রাজধানীর বাইরে রোগী বাড়ছে। এ বছরে আক্রান্তের তথ্য ও জরিপগুলোও সেই বার্তাই দিচ্ছে। তাই রাজধানীর বাইরে হটস্পটগুলো শনাক্ত ও অঞ্চলভিত্তিক ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি রাখতে হবে। পাশাপাশি এডিস মশা নির্মূলে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, দীর্ঘদিন মশা নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ বছর ডেঙ্গু বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ ঢাকার বাইরের কিছু জেলায় বিগত বছরগুলোর সকল রেকর্ড অতিক্রম করবে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও খুলনায় ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ হতে পারে। এই জেলাগুলো ছাড়াও ৬৪ টি জেলাতে ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটবে চলতি বছরে।
দীর্ঘদিন মশা নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ বছর ডেঙ্গু বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ ঢাকার বাইরের কিছু জেলায় বিগত বছরগুলোর সকল রেকর্ড অতিক্রম করবে ধারণা করা হচ্ছে।
মশার ধরনের বিষয়ে কবিরুল বাশার বলেন, গ্রামে ডেঙ্গু ছড়ায় মূলত এডিস অ্যালবোপিকটাস। এখন গবেষণা করে দেখা দরকার, এডিস অ্যালবোপিকটাস বেশি পরিমাণে ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করার সক্ষমতা অর্জন করেছে কি না। যদি এমন হয় তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ঢাকায় যে জরিপগুলো হচ্ছে, সেখানে এডিস মশার প্রকোপ খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ঢাকায় রোগীর সংখ্যা আনুপাতিহারে খুব একটা বাড়েনি। এর একটা কারণ এডিস মশা কম থাকা এবং ঢাকার মানুষ একাধিক ডেঙ্গু টাইপে আক্রান্ত হয়েছে। ফলে সেই টাইপের ডেঙ্গু দ্বারা এতবেশি আক্রান্ত হবে না কিন্তু ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হবে।
করণীয় প্রসঙ্গে ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত সকল উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে এনএস-১ ডেঙ্গু টেস্ট এভেইলেবল করা। চিকিৎসকদের পরামর্শ দেওয়া, কোনো রোগী জ্বর নিয়ে এলে প্রয়োজন মনে করলে তারা যেন ডেঙ্গু টেস্ট করান। এতে ডেঙ্গু আগে ধরা পড়বে। পাশাপাশি ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্টে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণে ঢাকার বাইরে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। উপজেলা মেডিকেল অফিসারসহ সকলকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেন সারাদেশে একই নিয়মে ও শৃঙ্খলভাবে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট করা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমরা গতবছর ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়বে বলে জানিয়েছিলাম। এ বছরও সেই আশঙ্কা রয়েছে। এ বছর রোগী বেশি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য আমরা ইতোমধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রদের নিয়ে বৈঠক করেছি। পাঁচ বছরে একটা পরিকল্পনা তৈরি করেছি এবং মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছি। ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফ্লুইড বা স্যালাইন। গত বছর স্যালাইন পাওয়া কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। এবছর কোনো সংকট নেই।
স্থানীয় পর্যায়ে প্রস্তুতির বিষয়ে সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, বাইরের রোগীকে ঢাকায় রেফার না করে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়ার প্রস্তুতি আমরা নিচ্ছি। এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি প্রতিরোধ কার্যক্রম এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য স্থানীয় সরকার ও নাগরিকদের দায়িত্ব নিতে হবে।