ধর্ম

ঐতিহাসিক মক্কা বিজয় দিবস আজ

আজ ২০ রমজান। সিয়াম সাধনার মাসের আক্ষরিক অর্থেই দ্বিতীয় দশক পূর্ণ হচ্ছে আজ। কিন্তু আজকের দিনটির গুরুত্ব বহু গুণ বেড়েছে এক ঐতিহাসিক কারণে। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার অধিকারী এ ঘটনাটি হলো মক্কা বিজয়।

ঐতিহাসিকদের মতে, মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়; যদিও পবিত্র আল কোরআনে হুদাইবিয়ার সন্ধিকেই প্রকাশ্য বিজয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং মক্কা বিজয় দুটিই মুহাম্মাদ (সা.) এর অতুলনীয় দূরদর্শিতার ফল।

হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে যে বিজয়ের সূত্রপাত হয়েছিল তার চূড়ান্ত রূপই ছিল মক্কা বিজয়। এই বিজয়ের ফলে মুসলমানদের পক্ষে আরবের অন্যান্য এলাকা বিজয় করা সহজসাধ্য হয়ে পড়ে। আর তাই ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ একটি ঘটনার সাক্ষী আজ ২০ রমজান।

ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হিজরতের অষ্টম বছরে ১০ হাজার মুসলিম সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মক্কা নগরী জয় করেছিলেন এদিনে। আজ থেকে ১৪৩৩ বছর আগে মহানবী (সা.) তৎকালীন আরব ভূমির সবচেয়ে প্রসিদ্ধ জনপদে বিজয় নিশান উড্ডীন করেছিলেন। এ ঘটনা ছিল মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের, সাফল্যের ও সন্তুষ্টির।

স্রষ্টাভোলা মানব জাতিকে সত্যপথের দিশা দিতে বনি আদমের শ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ধূলির ধরায় তশরিফ আনেন মরু আরবের এক জীর্ণ কুটিরে। আরবের শ্রেষ্ঠ গোত্রের শ্রেষ্ঠ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহর ঘরের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহর ঘরে বিবি আমিনার কোল উজালা করে শ্রেষ্ঠতম এ মহামানব পৃথিবীতে এসে শৈশবকাল থেকে নিজের চারিত্রিক মাধুর্য ও উন্নত মানবীয় গুণাবলি দ্বারা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন মক্কার মানুষদের। শত অনাচার ও অসুন্দরের মধ্যে একজন উন্নত চরিত্রের মানুষ প্রথম থেকেই মানবজাতির অধঃপতন ও নিম্নগামিতা অনুভব করেছিলেন।

৪০ বছর বয়সে ওহি লাভের পর যখন তিনি মানুষকে রাব্বুল আলামিনের দিকে আহ্বান জানালেন এবং সব ধরনের অন্যায় থেকে সরে আসতে বললেন, তখন এতদিনের চেনা মানুষেরাই তার বৈরী হয়ে গেল। মানুষের ইহ ও পরকালীন জীবনের কল্যাণ ও সাফল্যের পথে তিনি আহ্বান জানাতে লাগলেন। অথচ মক্কার লোকেরা তার বিরোধিতায় নেমে পড়ল। শুধু নবী করিম (সা.) নন, যারা ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন তাদের ওপরও নেমে এসেছিল নির্যাতন ও অত্যাচার। একপর্যায়ে মুসলমানদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে যায় অমুসলমানদের আচরণ। জীবন রক্ষা করাই তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমতি আসে হিজরতের। সুদূরের পল্লী ইয়াছরিব থেকে আহ্বান আসে ইসলামের নবী ও অনুসারীদের। শেষ নবীকে আশ্রয় দেওয়ার এবং বরণ করে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে সেখানকার আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা।

নবুওয়াতের ১৩তম বছরে মহানবী (সা.) মক্কা ছেড়ে ইয়াছরিবে হিজরত করেন। ইয়াছরিবের নাম হয়ে যায় মদিনাতুন নবী বা সংক্ষেপে মদিনা। এখান থেকে ইসলামের প্রসার ঘটে অভাবনীয় গতিতে। মক্কায় কোরাইশ গোত্র আরবে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় তাদের বিরোধিতা ছিল ইসলামের প্রসারে একটি বড় অন্তরায়। তাছাড়া তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতাও চালায়। বদর, উহুদ, খন্দক ইত্যাদি যুদ্ধে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে মুসলমানদের। তবে এর মধ্যে খোদায়ী মদদের কারিশমাও প্রত্যক্ষ করেছেন তারা। এরই ধারাবাহিকতায় আসে মক্কা বিজয়ের পালা।

তবে মক্কা জয়ের জন্য মহানবী (সা.) এর অভিযান পরিচালনার পেছনে কাজ করেছে হুদায়বিয়ার সন্ধি। হিজরি ষষ্ঠ বছরে সম্পাদিত এ চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছিল মক্কার কুরাইশরা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রতিকার চেয়েছিলেন নইলে সন্ধির সমাপ্তি হয়েছে মনে করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কুরাইশরা কোনো সাড়া না দেয়ায় তিনি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন।

অষ্টম হিজরির রমজান মাসে এ অভিযান পরিচালিত হয়। ২০ রমজান মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মক্কায় প্রবেশ করেন। প্রায় রক্তপাতহীন সে অভিযানে ইসলামের নবীর পতাকা সেখানে সমুন্নত হয়। আর সত্য ধর্মের গৌরব প্রতিষ্ঠিত হয় আরবের সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরীতে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) একক প্রভুর ইবাদতের জন্য যে বায়তুল্লাহ নির্মাণ করেছিলেন, তা ভরে ফেলা হয়েছিল মূর্তি ও বিগ্রহে। মহানবী (সা.) আল্লাহর ঘর থেকে ৩৬০টি মূর্তি অপসারণ করেন। আর এতদিন যারা ইসলামের শত্রুতায় সদাপ্রস্তুত ছিল, তাদের জন্য ঘোষণা করেন সাধারণ ক্ষমা। শান্তি ও মানবতার অনন্য নজির স্থাপন করলেন ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। তাই মক্কা বিজয়ের ঘটনা বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। আর সে কারণেই ২০ রমজান মুসলমানদের জন্য বিপুল গৌরবের স্মারক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d