ওয়ালটনের পণ্য কিনে বিড়ম্বনা
রাজধানী ঢাকার প্রগতি স্মরণী মধ্য বাড্ডার ওয়ালটন প্লাজা (এসটি) থেকে এসি কিনেছিলেন তানজীব ঐতিহ্য নামের এক ক্রেতা। কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা দেয় সমস্যা। দীর্ঘক্ষণ চালানোর পরও রুম ঠান্ডা হচ্ছিলো না। তীব্র তাপদাহে প্রচণ্ড গরমে সার্ভিস সেন্টারে কল করেও কোনো সুরাহা পাননি। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সার্ভিস দেয়ার কথা থাকলেও ৭ দিনের মাথায় সার্ভিস পয়েন্টে গিয়ে একপ্রকার জোর করেই টেকনেশিয়ান আনতে হয়েছে তাঁকে। দুজন এসে গ্যাস চেক আর ওয়াশ করে দিয়ে গেলে কয়েক ঘণ্টা ভালো চলে। এরপরের সমস্যা আরও ভয়াবহ। এবার রুম ঠান্ডাই হয় না। তারপর সার্ভিস সেন্টারে কল দিয়ে একজন দক্ষ টেকনেশিয়ান পাঠানোর অনুরোধ করেন। তবে সেই টেকনেশিয়ান ‘এটা সেটা’ বোঝানো ছাড়া কোনো কাজই করেননি বলে অভিযোগ তাঁর।
গত ২৭ এপ্রিল নতুন এসি কিনে একই সমস্যায় পড়েন মিরপুর ১১ নম্বরের বাসিন্দা রাসেল মাহমুদ। কাফরুল এলাকার ওয়ালটন এক্সক্লুসিভ (জয় ইলেকট্রনিক্স) শোরুম থেকে WSI – Krystaline 18M Plasma মডেলের একটি এসি কিনেন তিনি। এসি ইনস্টলেশনের একদিনের মধ্যেই রুম ঠান্ডা না হওয়ার সমস্যায় ভোগেন তিনি। এরপর সার্ভিস সেন্টারে জানালে ৭২ ঘণ্টার সময় চেয়ে নেয় তারা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এসি ইউজারদের বিভিন্ন গ্রুপে ওয়ালটন এসি নিয়ে নানা বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির এমন অসংখ্য অভিযোগ ভেসে বেড়াচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন সিভয়েস২৪কে বলেন, ‘দেশি হোক বা বিদেশি প্রতিষ্ঠান তাদের আফটার সেলস সার্ভিস বা বিক্রয় পরবর্তী সেবাটা খুবই নিম্নমানের। বিক্রয় পরবর্তী সেবাটা নিয়ে কোম্পানিগুলো বিক্রির আগে যেরকম অফারগুলো দেয় পরবর্তীতে তারা আর তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা করে না। যার কারণে মানুষ পরবর্তীতে ভোগান্তির শিকার হয়। তারা যেভাবে বলেছিলো ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই সার্ভিস দিবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা পাওয়া যায় না। রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি যেগুলো আছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। যখন ভুক্তভাগী রিপ্লেস করতে যায় বা ওয়ারেন্টি ক্লেইম করতে যায় তখন কোম্পানি তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না। এরকম অনেকগুলি ঘটনা আমরা পেয়েছি।’
এসব ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে জানিয়ে ক্যাব সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টি কার্ড নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ জানাতে পারেন। সেক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছে ওয়ারেন্টি কার্ড থাকলে নিয়ম অনুযায়ী সার্ভিস না পেলে তারা ব্যবস্থা নিতে পারবে। অনেক ভুক্তভোগী এটাকে ঝামেলা মনে করে কমপ্লেইনও করতে যায় না। এখন বিষয়টা হলো আমাদের কমপ্লেইন করতে হবে। কমপ্লেইন করে তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটা আদায় করার জন্য আমাদের সোচ্চার হতে হবে। দেশি হোক বা বিদেশি হোক সকল প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করা উচিত। নাহলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিবে।’
এমন অভিযোগ আর সমালোচনার বিষয়ে ওয়ালটনের কর্পোরেট অফিস, ডোমেস্টিক সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং অফিস, কর্পোরেট সেলস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাদের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ফেসবুকে তানভীর আহমেদ নামের একজন ওয়ালেটন এসি কিনে লিখেছেন, ‘গেল ঈদের ২-৩ দিন আগে ওয়ালটন ইনভার্না ১.৫ টন এসিটা কিনি, পরে কোম্পানি লোক এসে সেট করে দিয়ে যায়। সমস্যা হলো এসি ঠান্ডা হতো না, পরে ওদের লোক এসে বলে গ্যাস নাই। নতুন এসিতে গ্যাস চলে যাওয়াযটাই তো একটু অদ্ভুত। পরে ওদের লোক ৩-৪ বার এসে পরে এটা ঠিক করে। এতেই ৫-৭ দিন লাগে। জিনিসটা মোটেও ভালো লাগে নাই। পরে ভাবলাম ইনস্টলেশনই সমস্যা ভেবে ভুলে যাই।’
‘গত ২৫ এপ্রিলে আরেকটা এসি কিনি একই মডেলের ১.৫ টন ৬৮ হাজার টাকা দিয়ে, ১ দিন পর লোক এসে সেট করে দিয়ে যায়। ১ দিন আগে যখন সেট করে দিয়ে যায় তখন এসি ঠিক মত কাজ করছিল। ২৭ তারিখ মনে গতকাল রাতে এসি অন করে ঘুমাই, তখন ঠান্ডা হচ্ছিল। সকালে গরমে ঘুম ভাঙ্গে। এসি ঠিক মতোই চলতেছে। পরে দেখি শুধু এসির ফ্যান চলে। ঠান্ডা আর হয় না। সার্ভিস সেন্টারে কল দিলাম আর যে জায়গা থাকে নিলাম তাকেও জানালাম। এখন ওরা ৩-৪ দিন সময় নিলো। আমার কথা হচ্ছে নতুন এসি তে যদি এতো সমস্যা হয় তাইলে বাকি দিন কি হবে?’-যোগ করেন তিনি।
সাকলাইন শিশির নামের একজন লিখেন, ‘ওয়ালটন এসি কিনেছেন কিন্তু ভোগান্তি হয়নি এমন লোক পাওয়া কঠিন।’ আরিফ আকরাম নামের আরেকজন লিখেছেন, ‘ওয়ালটন এসি না যেকোন প্রোডাক্ট কিনে হয়রানির শিকার হইছে না এমন পাবলিক খুব কম।’ মুহাম্মাদ রাজীব নামের একজন লিখেছেন, ‘ওয়ালটনের এক্সপ্রিয়েন্স আমার মোটেও ভালো না।’ সুমি অরীন নামের একজন লিখেছেন, ‘বাজে, এক মাস ব্যবহার করছি এখন নষ্ট খুলে নিয়ে গেছে।’
নজরুল ইসলাম বাধন নামের একজন ওয়ালটন এসি ব্যবহারকারী আরেকজনকে ওয়ালটন এসি না কেনার পরামর্শ দিয়ে লিখেছেন, ‘ওয়ালটন না নেয়াই ভালো। আমি ইনভারনা ১৮ এইচ ১.৫ টন চালাচ্ছি গত বছর। কিনেছি থেকে ৩ বার টেকনিশিয়ান দেখাইছি আবার ২৮ এপ্রিল কমপ্লেইন দিয়ে রেখেছি এখনো সার্ভিস করতে আসেনি।’
মাহমুদ ইমন নামের একজন লিখেছেন, ‘শব্দ বেশি মনে হয় ট্রাক্টর চলতেছে।’
আরিফ হোসেন নামের একজন লিখেছেন, ‘এসিও ভালো না সার্ভিসও ভালো না।’
রায়হান নাদিম রাতুল নামের একজন লিখেছেন, ‘টাকা দিয়ে দুঃখ কিনলেন ভাই।’
মো. ইয়াসিন নামের একজন লিখেছেন, ‘খুবই বাজে। এসি দিয়ে পানি পরবে কয়দিন পর, সার্কিট নষ্ট হলে আর পাওয়া লাগবে না।’
হাবিবুর রহমান নামের একজন লিখেছেন, ‘ভালো না। পানি পরে ঘরের ভেতর। অনেকবার মেকানিক দেখালাম। খোচা খুচি করে আর পয়সা নেয়। কামের কাম কিছু হয় না।’
এইচ এম ইয়াসিন আহম্মেদ নামের একজন লিখেছেন, ‘২টা নিছিলাম। একটা নিহত হয়ে উপরের তাকে পরে আছে। আরেকটা মোটামুটি আহত অবস্থায় আছে।’
হাবিব সুমন নামের একজন লিখেছেন, ‘একেবারেই বাজে। আজ ৫দিন যাবত রিকুয়েস্ট করছি সার্ভিসিংয়ের জন্য। এখন পর্যন্ত কোনো কেউ যোগাযোগ করেনি। সার্ভিসিং তো দূরের কথা।’
ইসতিয়াক তাহমিদ নামের একজন লিখেছেন, ‘অনেক প্যারা খাইছি ওয়ালটন এসি নিয়ে। ৪ বছরে মধ্যে প্রথম বছরেই ২বার আউটডোর সার্কিট পাল্টিয়েছি। কমপ্লেইন করার ২ মাস পর সার্ভিস ম্যান আসে। বাজে অবস্থা।’
সজীব রায়হান নামের একজন অভিযোগ করে বলেন, ‘ওয়ালটন এর মতো বাজে সার্ভিস আর কোনো কোম্পানিতে আছে নাকি জানি না। আজ ১২ দিন হলো সার্ভিসিংয়ের জন্য রিকোয়েস্ট দিছি এখনও সার্ভিস এর জন্য লোক আসেনি।’
অদক্ষ টেকনিশিয়ান দ্বারা ওয়ালটন সার্ভিস দিচ্ছে বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
শুধু এসি নিয়ে বিড়ম্বনা এমন নয়। ওয়ালটনের ওয়ালটন ফ্রিজ নিয়েও আছে অভিযোগ। হাবিবুর রহমান রনি নামের একজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমি ওয়ালটন ফ্রিজের এর সাইড বাই সাইড ফ্রিজ নিয়েছিলাম ২০১৮ সালে। কেনার ১ বছর পর থেকেই ফ্রিজে সমস্যা দেখা দেয়। কুলিং প্রবলেম। এরপর থেকেই প্রতি বছরই সার্ভিস সেন্টারে এ পাঠাতে হয়েছে ফ্রিজ। ডাবল ডোরের সাইড বাই সাইড ফ্রিজ সার্ভিস সেন্টারে পাঠানোর চেয়ে যুদ্ধ জয় করাও সহজ। বার বার সার্ভিস সেন্টারে রিপ্লেস করতে চাইলে, ওনারা বলে ফ্রিজ রিপ্লেস হয় না।’
‘গত মার্চ মাসেই পঞ্চমবারের মত সার্ভিস করিয়ে আনলাম। তারপরও খাবার ভালো থাকছে না। ওয়ালটন আমার লাইফ একেবারে জাহান্নাম করে দিছে। আমি আর কখনোই আমার শত্রুকেও ওয়ালটন কেনার পরামর্শ দিব না।’-বলেন তিনি।
রিজওয়ান উদ্দিন চৌধুরী নামের একজন ওয়ালটন এসি ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল মেইবি ওয়ালটন এর এসি কিনা মাএ ১১ মাসের মাথায় এসিতে রুম ঠান্ডা হচ্ছে না, এসির নাকি গ্যাস শেষ! এখন এইটা তাদের কমপ্লেইন দিয়েছি প্রায় ১ মাসের কাছাকাছি ঠিক করানো নিয়ে তাদের কোনো খবর নেই! তারা খালি প্রতিদিন আসবে বলে কাস্টমার কেয়ারে কল দিলে বাট কেউ আসে নাহ….এই তীব্র গরমে শান্তির জন্য এসিটি কিনি বাট তাদের এই বাজে এসি মাএ ১১ মাসে এই অবস্থা। ৭০ হাজার টাকায় এসিটি আমি ক্রয় করি। তাদের ফল্ট তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে নাহ এখনও।’
এই স্ট্যাটসের মন্তব্যের ঘরে আল আমিন নামের একজন লিখেছেন, ‘আমি ফ্রিজ ঠিক করতে ২৩ এপ্রিল দিয়েছি এখনো পাইনি এতো দিন কেন লাগে। খবর নাই ফোন দিলে খালি বলে হবে কবে পাবো জানি না।’
আরেক ভুক্তভাগী মাহাবুবুর রহমান রাজীব লিখেছেন, ‘আমিও ঠকেছি ডাবল ডোর রেফ্রিজারেটর কিনে। এখন কুলিং হয় না। ২৩ এপ্রিল নিজ খরচে সার্ভিস পয়েন্টে দিয়ে আসছি এখনও ঠিক হয়নি।’