লাইফস্টাইল

‘কফি হাউসে’র সেই আড্ডাটা আর নেই

প্রায় দেড় শতাব্দী পুরোনো কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের আইকনিক ‘কফি হাউস’ বহু রাজনীতি, সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাক্ষী। এখনও তার অনেক কিছুই আছে আগের মতো, যেমন এখানকার কফি আর ফিশ ফ্রাই। আবার অনেক কিছুই বদলে গেছে, যেমন এখানকার টেবিলগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই জমিয়ে আড্ডা।

মান্না দে’র ‘কফি হাউস’ এর সেই এক টেবিলে তিন-চার ঘণ্টা বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডার দিন এখন শেষ।

দ্য হিন্দুর প্রতিবেদন বলছে, আজকাল যারা আসেন তাদের বেশিরভাগেরই থাকে ভীষণ তাড়া। খুব দ্রুত খাবার শেষ করেই বেরিয়ে যান। নতুন কেউ সে জায়গা দখল করে নেয়। আর এই পরিবর্তনই যেন পাল্টে দিয়েছে চিরচেনা কফি হাউসকে। যারা এক কাপ কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই পুরোনো কফি হাউসের আবেশ ধরে রাখতে চান, তাদের প্রতি যেন আর ইতিহাসের ধারা ধরে রাখতে রাজি নয় এই হাউজ।

আসবে, খাবে, টাকা দিয়ে চলে যাবে—নব যুগের এই রীতিতে ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে এর চিরচেনা ছবি।

জমজমাট ব্যবসা

১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং মাত্র ১৫ বছর আগেও যার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত দেখাচ্ছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটিই এখন সুদিন দেখছে। ঐতিহাসিক কলেজ স্ট্রিট বিল্ডিংয়ে শুধু বসার জায়গাই বাড়েনি, কলকাতার বাইরে বহরমপুরে এই প্রথম শাখা খুলতে চলেছে কফি হাউস। এপ্রিলের মাঝামাঝি পয়লা বৈশাখে যার উদ্বোধন।

ইন্ডিয়ান কফি ওয়ার্কার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড যারা কফি হাউস পরিচালনা করেন তার বর্তমান চেয়ারম্যান মোহম্মদ জাভেদ বলেন, ‘পরিস্থিতি অবশ্যই ভালো। আগে নিচতলায় ৪৪টি টেবিল ছিল, এখন ৫২টি। উপরের তলায় লোকে বসতে পারত ৩৭টিতে, সেটি বাড়িয়ে ৪২টি হয়েছে। এসবই হয়েছে গত দুই বছরে। তবে কফি হাউসের সংস্কৃতির দিক থেকে খুব বেশি কিছু পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তিত হয়েছে কেবল প্রজন্মের।’

মোহাম্মদ জাভেদের এটি দ্বিতীয় মেয়াদ। প্রতি মেয়াদ চলে পাঁচ বছর ধরে। কফি হাউসে ৩৫ বছর ওয়েটার হিসেবে কাজ করার পর তিনি এই দায়িত্ব পেয়েছেন।

বদলে যাচ্ছে সংস্কৃতি

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী জানান, কাজের সংস্কৃতিও বদলে গেছে।

তিনি বলেন, ‘এখানে যারা কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগই এখন তরুণ। আমরা এখন আর কাউকে এক কাপ কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকাকে উৎসাহিত করি না। এখানে সময় কাটাতে চাইলে অর্ডার দিতে হবে। শুধুমাত্র আড্ডার জন্য টেবিল দখলে রাখা যাবে না।’

এমন কঠোরতা এক দশক আগেও খুব একটা দেখা যেত না। ঐতিহ্য সচেতন কলকাতার কফি হাউস আর তার ওয়েটাররাও বুঝতে শুরু করেছে কেবল ২০ টাকার এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে দীর্ঘ আড্ডার আর সুযোগ নেই। অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার আগ্রাসনে শারীরিকভাবে হাজির হয়ে আড্ডার দিনকালও প্রায় যাইযাই।

‘আমার কলেজের দিনগুলোতে, ৮০’ এর দশকের গোড়ার দিকে, এমন সময় ছিল যখন আমরা সারা দিন এখানে কাটাতাম। আক্ষরিক অর্থেই সারাদিন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় সবাইকে এখানেই বসে থাকতে দেখেছি। বলছিলেন, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা অসীম কুমার চক্রবর্তী।

এখনও পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে কলেজের দিনগুলো ফিরে পেতে কফি হাউসে আসেন তিনি।

‘নষ্ট করার সময় নেই’

অসীম চক্রবর্তী বলেন, যে জমজমাট আড্ডা আর কোলাহলের দিন ছিল তা আর আগের মতো কিছুই নেই।

কফি হাউসে তিন দশকেরও বেশি সময় কাটিয়ে আসা ওয়েটার কাবুল বলেন, গ্রাহকদের যে তোড় তাতে তাকে সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয়।

তিনি বলেন, ‘আজকাল মানুষের হাতে সময় নেই। তারা আসে, খায় আর চলে যায়। তাদের নষ্ট করার মতো সময় নেই।’

যে প্রতিষ্ঠানে তিনি ৪০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন, একসময় ওয়েটার হিসেবে এবং এখন এটি পরিচালনাকারী সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান হিসেবে তার সবচেয়ে স্মরণীয় পর্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে মোহাম্মদ জাভেদ বলেন, ‘কোভিডের সময়কাল। সেটাই ছিল শ্রেষ্ঠ সময়, কারণ কাউকেই সেসময় কাজে আসতে হতো না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d