স্বাস্থ্য

করোনার চতুর্থ ডোজ: টিকা নেয়নি ৯৭ শতাংশ মানুষ

দেশে আবারও বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। ইতিমধ্যেই শনাক্ত হয়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট জেএন.১। তার প্রভাবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আক্রান্ত ও শনাক্তের হার ৬ শতাংশের নিচে নামছেই না। মাঝেমধ্যে ১০ শতাংশও ছাড়িয়ে গেছে। গত বুধবারও নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। তার আগের ছিল ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এমনকি ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে সংক্রমণ বেড়েছে চারগুণের বেশি।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, করোনা সংক্রমণের হার আরও বাড়তে পারে। তাই করোনার নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি সবাইকে আবার দ্রুত টিকা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রায় ৯ মাস টিকা কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর নতুন করে গত ২১ জানুয়ারি থেকে রাজধানী ঢাকার ৯টি কেন্দ্রে টিকা কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত ৩ জানুয়ারি স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকা প্রয়োগে সরকারকে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেয় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।

কিন্তু মঙ্গলবার রাজধানীর ফুলবাড়িয়া সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন টিকাদান ঘুরে দেখা গেছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা নেওয়ার লোক তেমন নেই। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কেন্দ্রগুলো ফাঁকাই ছিল। মাঝেমধ্যে দুয়েকজন এসে টিকা নিয়ে যান। এমনকি তাদের লাইনেও দাঁড়াতে হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিকা কর্মসূচিতে আগের মতো প্রচার-প্রচারণা এবার হয়নি। ফলে অনেক মানুষ টিকা দেওয়ার কথা জানেই না। তবে সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, তিনটি ডোজের টিকার দুটি নেওয়ার পর অনেকের তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ নেওয়ার আগ্রহ অনেক কম। তবে এরই মধ্যে অনেক মানুষই আবার টিকার আওতায় চলে এসেছেন। আর মানুষের মধ্যে করোনাভীতি আগের মতো নেই। এসব কারণে টিকাকেন্দ্রে মানুষের ভিড় নেই।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে করোনা প্রতিরোধে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম টিকার কার্যক্রম শুরু হয়। ওই দিন প্রথম টিকা নেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা। শুরুতেই সম্মুখসারির কর্মী এবং ৪০ বছরের বেশি নাগরিকদের টিকা দেওয়া হবে। এরপর গণটিকা দেওয়া শুরু হয় একই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি। পরে এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়। আর ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে তৃতীয় ডোজের প্রয়োগ শুরু হয়। তার পর পর্যায়ক্রমে স্কুল শিক্ষার্থীসহ চতুর্থ ডোজের প্রয়োগও শুরু হয়। এ ছাড়াও টিকা সংকটের কারণে ২০২৩ সালে প্রায় ৯ মাস টিকার তৃতীয় ও চতুর্থ ডোজ প্রয়োগ বন্ধ করা হয়। এমনকি টিকা সংকট ও মানুষের আগ্রহ না থাকায় ধীরে ধীরে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, টিকা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা অ্যাপসে এখন পর্যন্ত মোট নিবন্ধন করেছেন ১১ কোটি ৪৬ লাখ ৯১ হাজার ৭৬৮ জন। আর দেশে এখন পর্যন্ত করোনা টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১৫ কোটি ৯ লাখ ২২ হাজার ৯০২ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৮৮.৮৬ শতাংশ। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১৪ কোটি ২১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩৪ জন, যা জনসংখ্যার ৮৩.৭৩ শতাংশ। প্রথম বুস্টার ডোজ (তৃতীয় ডোজ) পেয়েছেন ৬ কোটি ৮৫ লাখ ৫৮ হাজার ৭৮৮ জন, যা জনসংখ্যার ৪০.৭০ শতাংশ। দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ (চতুর্থ ডোজ) নিয়েছেন ৫০ লাখ ৫২ হাজার ৫২ জন। ১২-১৭ বছর বয়সিদের মধ্যে প্রথম ডোজের টিকা পেয়েছেন ১ কোটি ৭৪ লাখ ১৪ হাজার ৩৫৩ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ১৬ কোটি ২৫ লাখ ৬ হাজার ৪৬৬ জন। আর ৫-১১ বছর বয়সিদের শিশুদের মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন ১ কোটি ৯২ লাখ ৯৮ হাজার ২৩১ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ১ কোটি ৫৮ লাখ ২১ হাজার ৬৭৩ জন।

অধিদফতরের হিসাব মতে, প্রথম ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের ৯৭.০৭ শতাংশ মানুষ চতুর্থ ডোজের টিকা নেয়নি। তৃতীয় ডোজের টিকা নেয়নি ৫৯.২৭ শতাংশ মানুষ।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ২০২৩ সালের জনসংখ্যা গণনা অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ৯১১ জন। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) দেওয়া তথ্য মতে, বিভিন্ন উৎস থেকে দেশে এ পর্যন্ত করোনার টিকা এসেছে ৩৭ কোটি ৬১ লাখ ২৭ হাজার ৯১০ ডোজ। এর মধ্যে অনুদানে পেয়েছে ১৮ কোটি ৬৯ লাখ ৩৪ হাজার ৭০ ডোজ, যা মোট ভ্যাকসিনের ৪৯.৬৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক উদ্যোগ হলো গ্যাভিকোভেক্স ফ্যাসিলিটি থেকে অনুদান পেয়েছে ১৬ কোটি ৭৫ লাখ ৪৬ হাজার ৪১০ ডোজ। অন্যান্য ১ কোটি ৯৩ লাখ ৮৭ হাজার ৬৬০ ডোজ। কোভ্যাক্সের সঙ্গে খরচ শেয়ার (কস্ট শেয়ারিং) ৮ কোটি ৭১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪০ ডোজ, ক্রয়কৃত ভ্যাকসিন ৯ কোটি ২০ লাখ ৬ হাজার ভ্যাকসিন।

সরেজমিন দেখা গেছে, ফুলবাড়িয়া সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, এখানে ষষ্ঠ তলায় টিকাদান কেন্দ্র। টিকা দিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা টেবিলে টিকার সরঞ্জাম নিয়ে বসে আছেন। সকাল থেকে দুপুর পযন্ত এ টিকাকেন্দ্র একেবারই ফাঁকা ছিল। কোনো মানুষজন নেই। তাই খোশগল্প করে অলস সময় পার করতে দেখা গেছে তাদের। মাঝেমধ্যে দুয়েকজন আসছেন। তারা কোনো ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই টিকা দিয়ে স্বস্তিতে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন।

ফুলবাড়িয়া সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা এক স্বাস্থ্যকর্মী জানান, অনেকেই জানেন না এখনও টিকা দেওয়া হচ্ছে। যারা টিভিতে দেখেছেন, তারা হয়তো আসছেন। এ কারণে কোনো ভিড় নেই।

ফুলবাড়িয়া সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ২৮ জানুয়ারি থেকে এ কেন্দ্রে করোনার তৃতীয় ডোজ ও চতুর্থ ডোজ টিকা দেওয়া শুরু হয়। সরকারি ছুটি বাদে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়। গত ১০ দিনে মোট ৪৮ জনকে এ কেন্দ্র থেকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ৬ জন, ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ জন এবং আজ (মঙ্গলবার) ছয়জনকে তৃতীয় ও চতুর্থ ডোজ টিকা দেওয়া হয়।

এ বুথের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার যখন থেকে টিকা কার্যক্রম শুরু করেছে, আমরা তখন থেকেই টিকা দিচ্ছি। শুরুতে সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ঢাকার বেশিরভাগ মানুষই টিকা নিয়ে নিয়েছে। বুস্টারের ক্ষেত্রেও যারা বিভিন্ন সমস্যার কারণে আগে নিতে পারেনি, তারা আসছে। তবে সংখ্যায় কম।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন টিকাদান ঘুরে দেখা গেছে, করোনারভাইরাস প্রতিরোধী টিকা নেওয়ার লোক তেমন নেই। সকালের থেকে দুপুর পযন্ত কেন্দ্রগুলো ফাঁকা। হঠাৎ দুয়েকজন আসছেন।
এখানে টিকা নিতে আসা নাজিমউদ্দিন রোডের বাসিন্দা মাসুম হোসেন বলেন, প্রথম তিন ডোজ নেওয়ার পর নানা সমস্যার কারণে আর চতুর্থ ডোজ নেওয়া হয়নি। আজ নিলাম কোনো ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই। টিকার ঝামেলা আপাতত শেষ। তাই খুব ভালো লাগছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে টিকাকেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সিনিয়র নার্স জানান, কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ২৫ জানুয়ারি থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ ডোজ টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। ১৩ দিনে মোট ১১৩ জনকে এই দুই টিকার ডোজ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আজ (মঙ্গলবার) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেওয়া হয় পাঁচজনকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) গিয়ে দেখা যায়, মঙ্গলবার দুপর পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ১১ জন। ৭ জন চতুর্থ ডোজ ও ৪ জন তৃতীয় ডোজ। দুপুর ১টায় রাজধানীর শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্র বন্ধ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টিকাগ্রহীতা না থাকায় একটু আগে বন্ধ করে চলে গেছেন দায়িত্বরত কর্মীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মুরাদ সময়ের আলোকে বলেন, দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর মানুষের মধ্যে আগের মতো ভীতি নেই। মূলত এ কারণে টিকার আগ্রহ বাড়ছে না। সচেতন মানুষরাও খুব একটা আসছে না। তিনি আরও বলেন, নতুন করে টিকার ডোজ দেওয়ার প্রচার হয়নি, এ কথা ঠিক। এর জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। সেটি হয়নি। প্রচার করব কীভাবে। যাদের প্রয়োজন হচ্ছে তারাই এই টিকা নিচ্ছেন। তবু এখন দিনে গড়ে দুইশর বেশি মানুষ টিকা নিচ্ছেন।

এ ব্যাপারে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, করোনার অমিক্রনের পর নতুন উপধরন জেএন.১ অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা আছে। তবে এতে রোগের লক্ষণে তীব্রতা কম। সাধারণ সর্দি-কাশির ক্ষেত্রে যেমন উপসর্গ হয় জেএন.১ আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এমনটাই হচ্ছে। তবে একে একেবারে হেলাফেলা করার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও যাদের একই সঙ্গে থাকা একাধিক রোগ আছে, তাদের জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ টিকার ওপর জোর দেওয়া উচিত।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা) ৩৪ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে করোনায় এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৪৮৩ জনের। আর আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৪৭ হাজার ৪০৭ জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d