কেনাকাটায় ‘কুপোকাত’ ক্রেতা
রোজা শুরুর অনেক আগে থেকেই চড়া সবজি, মুরগি, মাছ মাংসের বাজার। রোজা ঘিরে চিনি, ছোলা, মুড়িসহ সব পণ্যই বেচাকেনা চলছে বাড়তি দামে। এককথায় বলতে গেলে, রোজার বাজারে কেনাকাটায় ‘কুপোকাত’ ক্রেতা!
সোমবার (১১ মার্চ) চট্টগ্রাম নগরের খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, রিয়াজউদ্দিন বাজার, কাজীর দেউড়ি, বহদ্দারহাট, ঝাউতলা বাজারে সরেজমিনে দেখা গেছে বিক্রেতাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। তবে ক্রেতার চেহারায় চিন্তার ছাপ। জানালেন, বাধ্য হয়েই ইফতার, সেহেরির জন্য বাড়তি দামে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে নিতে হচ্ছে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, রমজান এলে অন্যান্য দেশে সব পণ্যের দাম কমে যায়। আর আমাদের দেশে তার উল্টো চিত্র। এখানের ব্যবসায়ীরা কেমনে পণ্যের দাম বাড়তি রাখবে; সেই চিন্তায় থাকে। আগে থেকে পণ্যের মজুদ করে রাখে। তার ওপর রমজানে বাড়তি দামে বিক্রি করে।
এদিকে, বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রতিদিন অভিযান চালানো হলেও কার্যত কোনো ফল পাচ্ছে না ক্রেতারা। ব্যবসায়ী-ক্রেতা উভয়ের ভাষ্য, উল্টো দাম বাড়ছে!
কাঁচাবাজারে ‘আগুন’
সাফিয়া খাতুন ইফতারের কাঁচা রসদ কিনতে নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজার ঘুরে দেখছেন কোন দোকানে দাম কম। পরে একটি দোকান থেকে ২ কেজি শসা, ৫০০ গ্রাম কাঁচা মরিচ ও বেগুনি বানাতে ২ কেজি বেগুন, ছোলা, বেসনসহ নানা পদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনেছেন। দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে অনেকটা ক্ষোভের সুরে বলে উঠলেন, ‘কম দামে পণ্য কিনতে এ বাজারে এসেছি। এখানেও সেই বাড়তি দাম। রমজানে জিনিসপত্রের দাম কম থাকার পরিবর্তে দাম বেড়ে যায়। আমরা মধ্যবিত্ত হয়ে বিপদে পড়েছি।’
শরীফ উদ্দিন নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘সবকিছুতেই ২০ টাকা বাড়তি। পরিবারসহ প্রথম রমজানে একটু ভালো কিছু দিয়ে ইফতার সেহরি করবো ভেবেই বাজারে আসা। মাংসের বাজারে গিয়ে ফেরত আসতে হয়েছে; গরুর মাংস কেনার মত টাকা নেই। স্থানীয়ভাবে এলাকায় ভাগে মাংস কিনতে চেয়েছিলাম টাকা দিতে দেরি হওয়ায় সেটাও পাইনি। শেষ ভরসা ছিল ব্রয়লার মুরগি; সেটাতেও দাম বেড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে নিয়েছি।’
রিয়াজউদ্দিন বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী আনিস আহমেদ বলেন, ‘পাইকারি দাম নির্ধারণ না করার কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আমাদেরকে সপ্তাহ পর পর পণ্য আনতে হয়। তাই আমরা যে দামে পণ্য কিনি, সপ্তাহজুড়ে কেনা দামের সঙ্গে লাভসহ বিক্রি করি। পাইকারি বাজারে দাম বাড়লে আমাদেরও বাড়াতে হয়। এতে ভোক্তা ও বিক্রেতা উভয়ে সংকটে ভোগে।’
‘উত্তাল’ মাংসের বাজার
দুদিনের ব্যবধানে দামে ‘উত্তাল’ মাংসের বাজারও। বাজারে হাঁড়সহ গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, হাঁড় ছাড়া গরুর মাংসের দাম ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা। এছাড়া মহিষের মাংস প্রতিকেজি ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। তবে সব বাজারে দেখা মেলেনি মহিষের মাংসের।
অন্যদিকে, খাসির মাংসের দাম ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ২০৫ থেকে ২১০ টাকা, সোনালী মুরগি ৩৫০ টাকা, দেশি মুরগি ৫৫০ টাকা এবং কক মুরগি ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা।
পাহাড়তলী বাজারের মুরগি বিক্রেতা আবদুর রহমান সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমরা নিজেরা মুরগি পালন করি না; পাইকারদের কাছ থেকে কিনে খোলা বাজারে বিক্রি করি। আমাদের কেনার ওপর পরিবহন খরচ কর্মচারীসহ মুরগির দাম নির্ধারণ করি। রমজানকে কেন্দ্র করে আমরা দাম বাড়াই না; যে মূল্যে আমরা কিনি সেই মূল্যেই আমরা বিক্রি করি।’
ডাল-ছোলার দাম এখনো বাড়তি
রমজান মাসকে ঘিরে অন্যান্য দ্রব্যের মতো গত মাসেই (ফেব্রুয়ারি) পাইকারিতে ডাল, ছোলার দাম বেড়েছিল। তবে গত সপ্তাহের বেড়ে যাওয়া দাম পাইকারিতে স্থির থাকলেও প্রভাব পড়েছে খুচরা পর্যায়ে।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে প্রতিকেজি ছোলা মানভেদে ৯৫ টাকা ১২ পয়সা থেকে ৯৭ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। আর ভালোমানের ছোলা বস্তাপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৬৫০ টাকায়। তবে এ দাম গত সপ্তাহ আগেও ছিল, সবশেষ ফেব্রুয়ারিতে বেড়েছিল। তবে এখন নতুন করে আর বাড়েনি। ডালও আগের দামেই আছে। নতুন করে আর বাড়েনি।
এদিকে খুচরা বাজারের তথ্য অনুযায়ী, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ছোলার দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখন ১১০ টাকা থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মটর ডালের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখন ৮০ টাকা, মুগ ডাল ১৭০ টাকা, খেসারির ডাল ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা দায়ী করছেন পাইকারি বাজারকে। তারা বলছেন, পাইকারিতে আমাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। বেশি দামে কেনার কারণে খুচরাপর্যায়ে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আমরা তো লাভ না করে লোকসানে পণ্য বিক্রি করতে পারব না।
খুচরা বাজারে দামের হেরফের
সালেহ আহমেদ নামে এক খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, ‘পাইকারিতে হঠাৎ করে দাম বেড়ে গেছে, এখানে আমরা কী করব। পাইকারি দাম অনুযায়ী খুচরায় বিক্রি করে থাকি। ফলে পাইকারি বাজারে দাম বাড়ালে আমাদেরও বেশি দামেই দিতে হয়। রোজা এলে বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে যায়, এখানে আমাদের কিছু করার নেই।’
খুচরা বিক্রেতাদের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সয়াবিন তেল (লিটার) বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। চিনি প্রতিকেজি ১৪৫ টাকা, চিড়া ৮০ থেকে ৯০ টাকা, মটর ডাল ৮০ টাকা, মুগ ডাল ১৭০ টাকা, খেসারির ডাল ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, ছোলা ১১০ থেকে ১২০ টাকা, পেঁয়াজ ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, রসুন ও আদা ২১০ থেকে ২২০ টাকা, মুড়ি ৮০ টাকা, আলু ৪০ টাকা, ফুলকফি ৫০ টাকা, বেগুন ৬০-৭০ টাকা, মুলা ৬০ টাকা, বাধা কফি ৬০ টাকা, টমেটো ৭০ টাকা, দেশি শসা ৮০ টাকা, হাইব্রিড শসা ৬০ টাকা, কাঁচামরিচ প্রতিকেজি ৬০ টাকা এবং গাজর ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
অভিযানের পর পণ্যের দাম আরও বেড়ে যায়!
রোজা ঘিরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে অভিযানে বাড়তি দামে পণ্য বিক্রির ‘অপরাধ’ ধরা পড়ার পরও টনক নড়েনি ব্যবসায়ীদের। তারা ঠিকই বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করছেন। শনিবার নগরের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে অভিযান চালালে ধরা পড়ে চিনি ও এলাচে বাড়তি দামের অনিয়ম। এ সময় জরিমানাও করা হয় ব্যবসায়ীদের। তবে একদিন পর সেই আগের দামেই (বাড়তি দাম) বিক্রি হচ্ছে সেখানেই।
অভিযানের পরও পণ্যের দাম না কমানোর কারণ জানতে চাইলে এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘যত অভিযান চালাবে, ততই আমাদের লাভ। আমাদের কোনো ক্ষতি হয় না। উল্টো অভিযানের পর বাজারে ওই পণ্যের দাম আরও বেড়ে যায়। তবে দিনশেষে ভোক্তাদের সমস্যা হয়। তারা বাড়তি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হয়।’
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আগে রমজানের বাজার করার জন্য মানুষের যে ধুম পড়তো। তা এ বছর নেই। অন্যসময় আমরা রমজানের আগের সপ্তাহ থেকে দম ফেলার ফুসরত পেতাম না। আর এখন বাজারে ক্রেতাই নেয়। তবে আমাদের কোনো জিনিসের সংকট নেই।’
‘প্রশাসন ব্যর্থ, ব্যবসায়ীরা সফল’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘পণ্যের দাম যা বাড়ার তা আগেই বেড়ে গেছে। গতকাল ও আজ নতুন করে শসা, লেবু, কাঁচামরিচ-এ জাতীয় আইটেমের দাম বেড়েছে। আমাদের মন্ত্রীরা আগে থেকে বলছিলেন— দাম বাড়তে দেওয়া হবে না। সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে। তারা যা বলছেন, তার কোনোটাই কাজে লাগাতে পারেননি। তারা সফল হননি; তবে ব্যবসায়ীরা সফল হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘রমজানের যা কিছু পণ্য আছে তা আগেই বেড়ে গেছে। তাই কয়েকটি দোকানে জরিমানা করে সেটা তো কখনও ফল পাওয়া গেছে বলে মনে হচ্ছে না। শনিবার যেরকম খাতুনগঞ্জে অভিযান চালিয়েছে তা সেখানেই শেষ। আজকের দিনের রেজাল্ট বলতে গেলে, অভিযান পর্যন্ত পণ্যের দাম কম ছিল; কিন্তু তা এখন আবার আগের দামে (বাড়তি দাম) ফিরে গেছে।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানিয়ে ক্যাব নেতা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তো জেলা প্রশাসককে বলেছিলেন— বাজার তদারকি করার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর যে নির্দেশনা তা যে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। অন্যান্য সময় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনের অনেকগুলো উদ্যোগ থাকে। তবে এ বছর দেখলাম— ফুল উৎসব, বসন্ত উৎসব, কনসার্ট এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিল; যার কারণে এগুলোতে (বাজার তদারকি) সময় দিতে পারছেন না। উনারা বলছেন, চট্টগ্রামকে সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া নগরী হিসেবে তৈরি করা হবে। এসব নিয়ে ব্যস্ত তারা। তাই এসব কারণে যেই ধরনের উদ্যোগ দরকার ছিল মনে করেছিলাম সেই ধরনের কোনো উদ্যোগ হয়নি এবার। সেই কারণে মানুষ সুফল পাবে বলে আশা করছি না।’
ভোক্তাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে নাজের হোসাইন বলেন, ‘ভোক্তাদের প্রতি একটা আমাদের আবেদন থাকবে— ভোক্তারা যাতে একসাথে বেশি জিনিস না কিনেন। এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ একসাথে যদি বেশি পণ্য কেনা হয়; তাহলে ব্যবসায়ীরা আরও বেশি উৎসাহিত হবে। তাই ভোক্তারা যদি সেখানে কম পরিমাণে পণ্য কিনে তাহলেই মোটামুটি কিছুটা সফল হবে।’