গুলিতে ঝাঁঝরা তাঁতী লীগ নেতা–নাগালে থাকলেও আসামি ধরছে না পুলিশ!
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় গুলি করে ও লোহার রড দিয়ে উপর্যুপরি আঘাতে মো. হাসমত (৩৫) নামে এক তাঁতী লীগ নেতাকে রক্তাক্ত জখম করেছেন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। এমনকি প্লাস দিয়ে হাত ও পায়ের নখও তুলে নেওয়া হয়েছে তার। ওই ব্যক্তির শরীরের বেশিরভাগ অংশ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছে। তিনি এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
এর আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে এগারোটায় সাতকানিয়ার পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের ইছামতি আলীনগর এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর ৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৪-৫ জনকে আসামি করে সাতকানিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী সাতকানিয়ার পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়ন তাঁতী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাসমতের স্ত্রী তাসমিন আক্তার।
আসামিরা হলেন- সাতকানিয়ার নলুয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর মালি বাড়ির কবির আহম্মদের ছেলে মো. মিজানুর রহমান (৩২), পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের উত্তর রামপুরের আবুল বশরের ছেলে মো. সুমন (৩০), একই ইউনিয়নের আলীনগর ইছামতি এলাকার নজির আহমদের ছেলে মহিম (৪২), একই এলাকার আব্দুল জব্বারের ছেলে শহীদুল ইসলাম শহীদ (২৮), আবুল খায়েরের ছেলে গিয়াসউদ্দিন রিয়াদ (৩৮), পশ্চিম ঢেমশার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর রামপুরা এলাকার উলা মিয়ার ছেলে মিজান (৩২), ৩ নম্বর ওয়ার্ড আলীনগর ইছামতির নজির আহমদের ছেলে মিজানুর রহমান শাকিল (৩০), একই এলাকার মৃত কামাল আহমদের ছেলে মো. ইব্রাহিম (৪৭) পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মো. করিমের আব্দুল্লাহ আল খালেদ (২৬)।
মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ভিকটিমের পথরোধ করে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে গুলি, গুরুতর জখম ও চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে মামলা দায়েরের পরও আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
মামলার বাদী আহত তাঁতী লীগ নেতা হাসমতের স্ত্রী তাসমিন আক্তারের অভিযোগ, আসামিরা এর আগে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা সাতকানিয়ার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। কিন্তু তারা সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সংসদ সদস্য আবু রেজা নেজামুদ্দিন নদভীর অনুসারী। নদভীর সঙ্গে তাদের অনেক ছবি ফেসবুকে আছে। এই কারণে পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তারে অনীহা দেখাচ্ছে। ফলে সন্ত্রাসীরা এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
জানা যায়, গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে এগারোটায় সাতকানিয়ার পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের ইছামতি আলীনগর এলাকার মনসুর শাহ জামে মসজিদের সামনে আহমদ কবিরের চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় আসামিরা দা, চুরি, কিরিচ, দুই নলা বন্দুক নিয়ে তাঁতী লীগ নেতা মো. হাসমতের ওপর হামলা করে। এসময় সন্ত্রাসীরা তাকে লোহার রড দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম করে। একপর্যায়ে হাসমতের ডান ও বাম পায়ে সন্ত্রাসীরা দুই নলা বন্দুক দিয়ে গুলি করে। এতে তার উভয় পায়ে, বুকে, গলায় জখম হয়; ভেঙে যায় শরীরের হাড়। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয়রা হাসমতকে উদ্ধার করে কেরানিহাটের আশশেফা হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা চমেক হাসপাতালে রেফার করেন। বর্তমানে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
জানা যায়, তাঁতী লীগ নেতা হাসমত হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি সাতকানিয়ার কবির আহম্মদের ছেলে মো. মিজানুর রহমান এর আগে র্যাবের হাতে ওয়ান শুটারগান ও ১০ রাউন্ড গুলিসহ আটক হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অস্ত্র আইন ও হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৬টি মামলা রয়েছে।
অন্যদিকে র্যাবের তথ্যমতে, মিজানুর রহমান একজন ভাড়াটে সন্ত্রাসী। নির্বাচন, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য মিজানকে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হয়। মিজান চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে গিয়েছেন এবং অস্ত্রের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মামলার ১ নম্বর আসামি মিজানুর রহমানের মুঠোফোন নম্বরে কয়েকবার কল করা হলেও সেটিতে সংযোগ স্থাপন করা যায়নি। তবে মামলার ৫ নম্বর আসামি রিয়াজ উদ্দিন রিয়াদ বলেন, ‘আমি কোনো কিছুর সাথেই জড়িত না। সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ মামলায় আমাকে জড়ানো হয়েছে। মূলত ঢেমশা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান রিদোয়ানুল ইসলাম সুমন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমাকে মামলায় জড়িয়েছেন। নির্বাচনে আমি নৌকার পক্ষ নেওয়াই কাল হয়েছে। তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।’
জানতে চাইলে মামলার ২ নম্বর আসামি মো. সুমন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়েছে কিনা জানি না। আমি এলাকায়ও থাকিও না৷’
অন্য অভিযুক্তদের মুঠোফোন নম্বরের কোনোটিতে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি; ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি সংসদ সদস্য আবু রেজা নেজামুদ্দিন নদভীর।
জানতে চাইলে সাতকানিয়া থানার ওসি ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘ঘটনার তদন্ত চলমান আছে। আমরা চেষ্টা করছি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে, শক্ত প্রমাণ সংগ্রহ করে যারা ঘটনায় প্রকৃত দোষী তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে। প্রকৃত দোষীকে আমরা অবশ্যই গ্রেপ্তার করব। এক্ষেত্রে আসামির রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।’
মামলার এক নম্বর আসামি মিজানুর রহমান এর আগে র্যাবের হাতে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং র্যাবের তথ্যমতে, তিনি একজন ভাড়াটে সন্ত্রাসী- এ বিষয়ে ওসির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওসি বলেন, ‘এই ঘটনায় মিজানুর রহমানের সম্পৃক্ততা কতটুকু, সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি। আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, যাচাই-বাছাই ও বিচার-বিশ্লেষণ করছি। এতে যদি প্রমাণ হয় সে দোষী তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই সর্বোচ্চ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’