চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামের শেভরণ বন্ধের নির্দেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের, ‘ভুল শোধরাতে’ ৭ দিনের সময় সিভিল সার্জনের

নানা অনিয়মের কারণে চট্টগ্রামে শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের জন্য ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে অধিদপ্তর থেকে।

গত ১৮ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. হাবিবুল আহসান তালুকদার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন নির্দেশনার ১১ দিন পার হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি শেভরণের বিরুদ্ধে। উল্টো ‘ভুল শোধরাতে’ তাদের আরও সাতদিন সময় দিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন। এজন্য এখনও কার্যক্রম চালু আছে প্রতিষ্ঠানটির।

তবে শেভরণের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াস চৌধুরী। তিনি জানান, লাইসেন্স স্থগিত করার চিঠিটি শেভরণ কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হয়েছে। শেভরণের লাইসেন্স স্থগিত করা হলেও তারা কার্যক্রম চালাতে পারবে। কারণ সেখানে অনেক বড় বড় চিকিৎসক রোগী দেখেন। তাদের অনিয়মগুলো সমাধান করলে বা সপক্ষে প্রমাণ দিতে পারলে স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া হবে।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সাধারণত লাইসেন্স স্থগিতের অর্থ কার্যক্রম বন্ধ থাকা। এরপরও খোলা রাখা মানে প্রতিষ্ঠানটির হাত অনেক লম্বা। সিভিল সার্জনও তাদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না।

এর আগে তদন্ত ও অনুসন্ধান চালিয়ে শেভরনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রমাণ পায় চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিস। পরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ১০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যবস্থা নিতে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে শেভরণের জেনারেল ম্যানেজার পুলক পারিয়াল বলেন, ‘আমাদের সাতদিনের সময় দেওয়া হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে আমাদের ত্রুটিগুলোর বিষয়ে আবার রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছাড়াও আমাদের এখানে আই হসপিটাল ও ডেন্টাল ইউনিট রয়েছে। সিনিয়র চিকিৎসকরাও চেম্বার করেন। যার কারণে আমাদেরকে সময় দেওয়া হয়েছে।’

চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন, ‘শেভরণকে সাতদিনের সময় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তারা তাদের ভুল-ত্রুটি শোধরানোর ওপর রিপোর্ট জমা দেবে।’

শেভরণের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ- ভুল রিপোর্ট দেওয়া, আট বছর আগে মারা যাওয়া চিকিৎসকের নামে রিপোর্ট সরবরাহ, বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা আদায় ও মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট (স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ব্যবহৃত রাসায়নিক মিশ্রণ) ব্যবহারের মতো ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রামের নামি ডায়াগনস্টিক সেন্টার শেভরণের বিরুদ্ধে। একাধিক অভিযোগ চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে জমা পড়লেও এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

গত ১ মে পেটের ব্যথা নিয়ে শেভরণের জরুরি বিভাগের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আলট্রাসনোগ্রাফি ও এক্স-রে করান আমান উল্লাহ নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। এরপর ডাক্তার রিপোর্ট দেখে এপেন্ডিসাইটিস বলে শনাক্ত করেন এবং অপারেশন করানোর জন্য বলেন। পরে অন্য হাসপাতালের আরও দুই চিকিৎসকের পরামর্শে আবারও টেস্ট করান আমান। টেস্টে এপেন্ডিসাইটিসের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি, পাওয়া যায় পিত্তথলীতে পাথর।

গত ১৭ জুলাই ডেঙ্গু পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত ফি আদায় করায় অভিযোগে শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। একদিন পর আবার ল্যাবটি খুলে দেওয়া হয়। ওই সময় ল্যাবটির বিরুদ্ধে ৩০০ টাকার পরিবর্তে ডেঙ্গু এনএস ওয়ান পরীক্ষার ফি ১ হাজার ৬০০ টাকা ও আইজিজি বা আইজিএম পরীক্ষার ফি ১ হাজার ২০০ টাকা আদায় করার অভিযোগ উঠেছিল।

সর্বশেষ গত ২৬ আগস্ট রোকেয়া বেগম নামের এক রোগীকে শেভরণের দেওয়া ইকোকার্ডিওগ্রাফির রিপোর্টে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রেজাউলের নাম উল্লেখ ছিল। অথচ ওই চিকিৎসক মারা গেছেন ৮ বছর আগে। কিন্তু তার নামে রিপোর্ট দিয়েছে শেভরণ। এই ব্যাপারে অভিযোগও জমা পড়েছে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসে।

এছাড়া গত বছরের ২২ সেপ্টম্বর শেভরণ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযানে গিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহারের প্রমাণ পায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অথচ শেভরণ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করে। পরে প্রতিষ্ঠানটির ফ্রিজেও মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া যায়। এজন্য প্রতিষ্ঠানটিকে ১ লাখ টাকা জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়। কিন্তু এরপরও থেমে নেই শেভরণের ‘দুই নম্বরি’।

তারও আগে ২০২২ সালের আগস্টের শুরুর দিকে শেভরণ ও এপিকের দেওয়া ক্যান্সার শনাক্তের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে অপারেশন করা হয় আইনুর নাহার সীমা নামে এক গৃহবধূকে। অপারেশনের পর সীমার শরীর পাওয়া টিস্যু চট্টগ্রামেরই অন্য একটি বিশেষায়িত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার পর দেখা যায়, সেখানে ক্যান্সারের কোনো উপস্থিতিই নেই। কিন্তু অপারেশন-পরবর্তী তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ওই গৃহবধূ ১৯ আগস্ট মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d