চট্টগ্রাম ওয়াসা: ‘ঝুঁকির অজুহাতে’ আবারও কম লাভে এফডিআর রাখা হচ্ছে
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সরকারি ও বেসরকারি মিলে চট্টগ্রাম ওয়াসায় মোট ২৬টি ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা পড়ে। এর মধ্যে রোববার (২৯ অক্টোবর) ৩টি ব্যাংকে মোট ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা আগামী তিন মাসের জন্য স্থায়ী আমানত (এফডিআর) হিসেবে রাখতে সম্মতি দিয়েছেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ। যার প্রথমটি আইএফআইসি ব্যাংকের চকবাজার শাখায় ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে ১ কোটি টাকার। দ্বিতীয়টিও একই হারে একই সময়ের জন্য আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের আন্দরকিল্লা শাখায় ১ কোটি টাকার। আর তৃতীয়টি ইউনিয়ন ব্যাংক লালদিঘী শাখায় ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে ৫০ লাখ টাকার৷ অর্থাৎ বেশি লাভে সবচেয়ে কম টাকা জমা রেখেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। অপরদিকে কম লাভে ৪ গুণ বেশি টাকা জমা রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসায় এফডিআর জমা রাখা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে চলছে ‘কমিশন বাণিজ্য’। প্রায় সময় ২৫-৫০ শতাংশ কম লাভে কয়েকটি ব্যাংকে বেশি পরিমাণ টাকার এফডিআর রাখা হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ আয় হারাচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে ব্যাংক বাছাইয়ে গোপনে ‘কমিশন’ নিশ্চিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। অভিযোগ, যেসব ব্যাংকের যেসব শাখা জড়িত কর্মকর্তাদের পকেট ভরাচ্ছেন সেসব ব্যাংকেই এফডিআইআর জমা করা হচ্ছে কম লভ্যাংশ হারের পরও। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছে ওয়াসার বেশ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা। এ কাজ করতে গিয়ে তারা নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছেন। কৌশল হিসেবে ৬ মাস কিংবা ১ বছর মেয়াদকে এড়িয়ে ৩ মাস মেয়াদকে বেছে নিচ্ছেন। ওয়াসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি কমিশন বাণিজ্যেরই অংশ।
এসব অনিয়ম ও কমিশন বাণিজ্য সম্পর্কে বিভিন্ন সময় জানতে চাইলে বরাবরই ওয়াসার এমডি, ডিএমডি থেকে শুরু করে সকলের এক কথা- বিনিয়োগ ঝুঁকি থাকায় বেশি লাভের প্রস্তাব দেওয়া ব্যাংকগুলোর প্রস্তাব আমলে নিতে পারছে না ওয়াসা। এক্ষেত্রে সংস্থাটির কর্মকর্তারা ওই ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের জন্য অনিরাপদ মনে করছেন। ওই সব ব্যাংকের হাতে ওয়াসার অর্থকে ‘অনিরাপদ’ হিসেবে দেখছেন তারা। যুক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি ভালো নয় বলেও উল্লেখ করছেন কোনও কোনও কর্মকর্তা। যদিও ঝুঁকিপূর্ণ আর ঝুঁকিমুক্ত বিবেচনা করার পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন আছে। ইতিপূর্বে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা কি কি ধরণের ক্ষতির মুখে পড়েছে তা জানাতে পারেননি ওয়াসার প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা।
জানা যায়, গতকাল ২৯ অক্টোবর আইএফআইসি ব্যাংকের চকবাজার শাখায় ৮.৫০ শতাংশ সুদে ১ কোটি টাকা, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের আন্দরকিল্লা শাখায় একই হারে ১ কোটি টাকা ও ইউনিয়ন ব্যাংকে লালদিঘী শাখায় ৮.৭৫ শতাংশ সুদে ৫০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্তে সম্মতি প্রকাশ করে সই করেছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ডিএমডি (উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক) লাল হোসেন ও এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) এ কে এম ফজলুল্লাহ।
অথচ বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক দেওয়ানহাট শাখা ৩, ৬ ও ১২ মাস মেয়াদের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ লাভ দেবে বলে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দুইবার প্রস্তাব দিয়েছে। সিটি ব্যাংক ও আর নিজাম রোড শাখা ৩ মাসের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ৫০ ও ৬ মাসের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং ১২ মাসের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ সুদে প্রস্তাব দিয়েছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের পথেরহাট শাখা ৯ শতাংশ সুদে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ব্যাংকের সিডিএ এভিনিউ শাখা ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছে।
অভিযোগ ওঠেছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আল মেহেদী শওকত আজম এমডিকে দিয়ে কম লাভের এফডিআর আবারও পাশ করিয়ে নিয়েছেন। আর মোটা অঙ্কের কমিশন ভাগাভাগি করছেন। এতে আবারও বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে সরকার।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াসার প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আল মেহেদী শওকত আজম একুশে পত্রিকাকে বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসার অর্থকে নিরাপদে রাখতেই এটি করা হয়েছে। কেননা যেসব ব্যাংক বেশি লাভে অফার দিয়েছে সেসব ব্যাংকের অবস্থা ভালো নয়। আগে কয়েকটি ব্যাংক থেকে আমাদের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যামেল রেটে তারা পেছনের দিকে।
তবে ব্যাংকগুলো কেন ঝুঁকিপূর্ণ? ইতিপূর্বে বিনিয়োগ করে কী ধরণের সমস্যায় পড়তে হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে জানাতে পারেননি এ কর্মকর্তা।
প্রশ্ন ওঠেছে, যেসব ব্যাংকে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেসব ব্যাংক ক্যামেল রেটিংয়ে “বি” ক্যাটাগরিতে আছে। আবার যেসব ব্যাংক ৮ দশমিক ৭৫ ও ৯ শতাংশ লাভে এফডিআর রাখার প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু গ্রহণ করা হয়নি সেসব ব্যাংকের ক্যামেল রেটও “বি”। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, একই রেটিংয়ে থাকার পরও বেশিটা গ্রহণ করা হয়নি কেন? তাছাড়া চট্টগ্রাম ওয়াসাকে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া বেশিরভাগ ব্যাংক ক্যামেল রেটিংয়ে “বি”তে রয়েছে। যদিও এর আগে আইএফআইসি ব্যাংকের এফডিআর নগদায়ন করতে মতামত দিয়েছিলেন প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আল মেহেদী শওকত আজম। এবার একই ব্যাংকের একই শাখায় এফডিআর করার পক্ষে তিনি। অর্থাৎ কিছুদিন আগে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক স্বল্প সময়ের মধ্যে আবার ঝুঁকিমুক্ত হয়ে গেল।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার সিনিয়র অডিট অফিসার রক্তিম দেব একুশে পত্রিকাকে বলেন, একই ব্যাংকে নগদায়ন করা হলে আমার কাছে অডিট আসে না। নতুন করে করা হলে অডিট আসবে। এফডিআর নগদায়ন অডিটের ঝামেলা এড়াতে করা হয়ে থাকতে পারে। তবে এর আগে আইএফআইসি ব্যাংক চকবাজার শাখায় যে এফডিআর প্রস্তাব করা হয়েছিল সেটি হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
একইসাথে ঝুঁকিমুক্ত, নিরাপদ বিনিয়োগের লক্ষ্যে কম লাভ হওয়ার পরও এফডিআর জমা করা হচ্ছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, রিফান্ড করতে যেন সুবিধা হয় সেজন্য এটি করা হচ্ছে। কেননা একটি ব্যাংক যদি ভালো হয় এবং তার রেট যদি সবার বেশিও হয়। তারপরও সবকটি এফডিআর সেখানে রাখা যাবে না। আজকে আপনি যেগুলোর কথা বলছেন সেগুলোর ব্যাপারে আমি অবগত নেই। আমি এখনও জানি না।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক কাজী শহিদুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমরা তো একটাও দিতে চাইনি। তবুও দুয়েকটা দিতে হচ্ছে। একদম না দিয়ে পারা যাচ্ছে না। এখন ধীরে ধীরে নগদায়ন করার সিদ্ধান্ত হচ্ছে।