চট্টগ্রামচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চবি: উপাচার্যহীন ১৭ দিন, আলোচনায় আছেন যারা

১৭ দিন ধরে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যহীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে প্রশাসনিক কার্যক্রম।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অচলাবস্থা নিরসনে সরকার উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করলেও এরইমধ্যে নিজেদের মতাদর্শের ভিসিকে চেয়ারে বসানোর প্রশ্নে দ্বিধা-বিভক্ত চবি’র শিক্ষকরা।
এদিকে ভিসি-প্রোভিসি নিয়োগে আলোচনায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধ ডজনেরও বেশি শিক্ষক।

তারা হলেন- মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল ফোরকান, ফিন্যান্স বিভাগে অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দীন খান, একই বিভাগের অধ্যাপক এস এম নসরুল কদির।

এ তালিকায় আরও আছেন প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া, লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আমির মোহাম্মদ নছরুল্লাহ এবং বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আল আমিন, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান।

জানা গেছে, মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর থাইল্যান্ড থেকে করেছেন দ্বিতীয় মাস্টার্স। এছাড়া কোস্টাল এনভায়রনমেন্ট মডেলিং বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার পর পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কাজ করছেন তিনি। এছাড়া পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন এডিবি, ইউএসএআইডি, ব্র্যাকের মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। যেহেতু সরকার জলবায়ু বিষয়কে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন, সেক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা এ শিক্ষক রয়েছেন সরকারের সুনজরে। তবে সর্বশেষ ঘটে যাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তেমন কোনো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি তাঁকে।

উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে আছেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল ফোরকান। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর যুক্তরাষ্ট্রের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদা দলের অন্তর্ভুক্ত হলেও কখনও সক্রিয় ছিলেন না এ শিক্ষক। উল্টো হলুদ দলের শিক্ষকদের সঙ্গে ছিল তার বেশ সখ্যতা। শুধু তা-ই নয়, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন বেশ সুযোগ সুবিধা। ফলে অনেক অনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও পার পেয়েছেন তিনি। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নীরব ভূমিকায় ছিলেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষক ড. শামীম উদ্দীন খানও আছেন আলোচনায়। চবি গণিত বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর পাশের দেশ ভারত থেকে রিসোর্স ইকোনমিক বিষয়ে পিএইচডি করেন। জামায়াত মতাদর্শের এ শিক্ষক সর্বশেষ চবির সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিরোধী পক্ষ থেকে সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের পক্ষে সরব ছিলেন তিনি। এ নিয়ে নিজ সংগঠনের ব্যানারে বিবৃতিও দিয়েছেন।

একই বিভাগের আরেক অধ্যাপক এস এম নসরুল কদিরও আছেন উপাচার্য হওয়ার আলোচনায়। বিগত সরকারের সময় দেশব্যাপি বিএনপি যখন অনেকটাই কোণঠাসা, তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছিলেন তিনি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি মতাদর্শের শিক্ষকদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। শিক্ষকতা জীবনে পিএইচডি না থাকায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিলেন সক্রিয়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিভিন্ন মন্তব্য করতে দেখা যায় এ শিক্ষককে।

প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সভাপতি ও হালদা গবেষক হিসেবে সুপরিচিত অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়ার নামও রয়েছে আলোচনায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তরের পর একই বিভাগ থেকে অর্জন করেছেন পিএইচডি। দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেছেন হালদা রিসার্চ সেন্টার। বর্তমান সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ও পূর্ব পরিচিত হওয়ায় ভিসি হওয়ার দৌড়ে কিছুটা এগিয়ে আছেন তিনি। সর্বশেষ আন্দোলন নিয়েও তিনি সরব ছিলেন।

লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আমির মোহাম্মদ নছরুল্লাহও আছেন উপাচার্য হওয়ায় আলোচনায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। ম্যানেজমেন্ট স্টাডিস বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন লন্ডনের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও ছিলেন সরব।

এছাড়া শোনা যাচ্ছে বন ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আল আমিনের নাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষে স্নাতকোত্তর করেছেন জার্মানি থেকে। জলবায়ু পরিবর্তন ও কার্বন নিঃসরণের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে যুক্তরাজ্যের ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেছেন পিএইচডি। তাঁর লেখা কয়েকটি বই বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চবি জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতির দায়িত্বে থাকা এ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভোস্ট, প্রক্টরসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সরব ভূমিকা পালন করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে।

প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান রয়েছেন আলোচনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে পিএইচডি করেছেন জাপানের এহেমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণা কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন। জামায়াত মতাদর্শের এ শিক্ষক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কাজ করেছেন।

এই আট শিক্ষক ছাড়াও ভিসি হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন, সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন।

সরকার পরিবর্তনের পর গত ১২ আগস্ট উপাচার্য ও উপ উপাচার্যের পদত্যাগের পর অনেকটাই নীরব আওয়ামী মতাদর্শের শিক্ষকরা। উল্টো চিত্র বিএনপি-জামায়াত মতাদর্শী শিক্ষকদের। উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে এরই মধ্যে দ্বিধা-বিভক্ত হয়েছেন তারা। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদ আদর্শে উজ্জীবিত শিক্ষক সমাজের ব্যানারে বিবৃতি দেয় একটি সংগঠন। এতে উল্লেখ করা হয়, চবি শিক্ষক শামীম উদ্দিন খানকে উপাচার্য হিসেবে দেখতে চান তারা। তবে এতে আপত্তি জানান জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম নামের আরেকটি সংগঠন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পরিবর্তিত এ সময়ে প্রয়োজন একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবান্ধব উপাচার্য; যিনি দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, যিনিই উপাচার্য হোক- বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে সেটিই চাওয়া। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয় হবে সেশনজট মুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত। ভিসির দায়িত্ব পাওয়া বড় বিষয় নয়, দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ। যিনিই এ চেয়ারে বসুক, আমাদের প্রত্যাশা থাকবে- শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যাতে কাজ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়।

অন্যদিকে, দীর্ঘদিন উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদ শূন্য থাকায় আটকে আছে প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজ। সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় এখনও শুরু করা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম। যার ফলে সেশনজটের কবলে পড়তে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমদ বলেন, আর্থিক বিষয় এবং নীতি নির্ধারণী কাজ ছাড়া নিয়মিত কাজগুলো চলছে। উপাচার্যের পদ শূন্য থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মূল সনদ দেওয়া যাচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d