চাকরি দেওয়ার নামে ১৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার। তার আপন ভাতিজা আফজার কামাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে উঠেছে নিয়োগ কেলেংকারির ভয়াবহ অভিযোগ। চতুর্থ শ্রেণীর চাকরি দেওয়ার নাম করে চার ব্যক্তি থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন ১৮ লাখ টাকা। টাকা লেনদেনের সকল ডকুমেন্টস হাতে আসে পূর্বকোণের। এর মধ্যে ৭ লাখ টাকা আফজারের ব্যাক্তিগত ব্যাংক একাউন্টে এবং ৬ লাখ টাকা পাঠানো হয় ৭টি বিকাশ ও নগদ একাউন্ট নম্বরে। বাকি ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় সরাসরি আফজারের হাতে। টাকা নিলেও প্রার্থীদের চাকরি না দিয়ে উল্টো মামলার ভয় দেখাচ্ছেন আফজার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২৪ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চারজনকে চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির লোভ দেখান আফজার। চারজনের মধ্যে একজন শেখ রাজু আহম্মেদ। তার বাবা জালাল চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা। রাজু চট্টগ্রাম শহরে ইট ও বালু সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করেন। তার মাধ্যমে বাকি ৩ জন আফজারকে টাকা প্রদান করেন। সর্বপ্রথম ২০২৩ সালের ৩ জুলাই সকাল সাড়ে ১১টায় আফজারের ব্যাক্তিগত ইসলামি ব্যাংক একাউন্টে হাটহাজারী ব্রাঞ্চ থেকে ১ লাখ টাকা দেন রাজু। একাউন্ট নম্বর ২০৫০৩০৪০২০১৩০৩৩০৫। এরপর ১৬ ও ১৯ অক্টোবর ২০২৩ সালে একই একাউন্ট নম্বরে হাটহাজারী ব্রাঞ্চ থেকে পাঠান ২ লাখ করে মোট ৪ লাখ টাকা। এর বাইরে ছয়টি বিকাশ ও নগদ নম্বরে বিভিন্ন সময়ে রাজু পাঠান ৭ লাখ টাকা।
নম্বরগুলো পূর্বকোণের কাছে সংগৃহীত আছে। বাকি টাকা দেওয়া হয় চট্টগ্রাম শহরের চকবাজারে সরাসরি আফজারের হাতে। আফজারকে দেওয়া ১৮ লাখ টাকার মধ্যে ৬ লাখ টাকা প্রধান ভুক্তভোগী রাজু আহম্মেদের। বাকি ৩ জন প্রার্থী দিয়েছেন ৪ লাখ করে ১২ লাখ টাকা। কথা ছিলো চাকরি হয়ে গেলে বাকি ৬ লাখ টাকা তারা পরিশোধ করবেন। কিন্তু গত ১৯ মার্চ শিরিন আখতারকে সরিয়ে ড. মো. আবু তাহেরকে চবির নতুন উপাচার্য নিয়োগ দিলে চাকরি দিতে ব্যর্থ হয় আফজার। যদিও চাকরির শেষ দিনে মোট ৪০ জনকে অবৈধ নিয়োগ দিয়ে যান সাবেক এই উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র মতে, সাবেক এই উপাচার্য তার চার বছরে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন।
এদিকে আফজারের ব্যক্তিগত একাউন্টের ব্যাংক স্টেটমেন্ট ঘেঁটে দেখা যায় চাঞ্চল্যকর টাকা লেনদেনের হিসেব। গত বছরের ৩ জুলাই থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ মাসে তার একাউন্টে জমা হয় ৪৭ লাখ ৩৯ হাজার ৪৫২ টাকা। যার অধিকাংশই জমা হয়েছে ইসলামি ব্যাংকের হাটহাজারী ও মদনহাট ব্রাঞ্চ থেকে। চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অফিসার হয়ে চার মাসে এতো টাকার লেনদেন কিভাবে করেছে আফজার তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।
ভুক্তভোগী শেখ রাজু আহম্মেদ বলেন, উনি দেব পাহাড়ে তার বাসায় আমাকে চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির আশ্বাস দেয় এবং বলে আরও কয়েকজন যোগাড় করতে। তার কথায় আরও তিনজনসহ আমরা মোট চারজন ১৮ লাখ টাকা তাকে দেই। তিনি প্রথমে আমাকে অফিস পিওন হিসেবে চাকরি দিবে বলে জানান। এরপর বলে সোহরাওয়ার্দী হলের বেয়ারা হিসেবে ওকে করে দিবেন। কিন্তু সেখানে মন্ত্রীর সুপারিশের কেউ চাকরি পেয়েছে জানিয়ে সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু হলে ফেব্রæয়ারি মাসের মধ্যে চাকরি কনফার্ম করে দিবেন বলে জানায়।
রাজু আহম্মেদ আরো বলেন, কিন্তু এরপর থেকে তিনি আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তিনি আমাদের চারজনের কাউকেই চাকরি দেননি। এখন অন্য যারা টাকা দিয়েছে তারা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য আমাকে চাপ দিচ্ছে। বিষয়টি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে আমি জানাই। রেজিস্ট্রার আফজারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি উল্টো আমার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন। টাকা ফেরত না পেলে আমি আফজারের বিরুদ্ধে মামলা করবো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এম নুর আহমদ বলেন, সে (ভুক্তভোগী) বিষয়টি আমাকে জানিয়েছে। তারা উভয়ই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ না। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের হতো তাহলে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিলো। তার (ভুক্তভোগী) উচিত দেশীয় আইনে ব্যবস্থা নেওয়া।
এ ব্যাপারে আফজার কামাল চৌধুরী ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতারের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা সাড়া দেননি।
উপাচার্যের ভাতিজার এমন নিয়োগ কেলেংকারি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল হক বলেন, এমন অনৈতিক কাজগুলো যারাই করেন সেটা হোক উপাচার্য, অথবা উচ্চপদস্থ ব্যাক্তি, তারা তাদের ঘনিষ্ঠজনের উপর নির্ভর করে থাকেন। কারণ তাদের নিরাপত্তার একটা বিষয় থাকে। তাছাড়া এর আগে অডিও কেলেংকারি, নিয়োগে অনিয়ম-পক্ষপাতদুষ্টতা, অযোগ্যদের নিয়োগদানের প্রচেষ্টা, নিয়োগবোর্ডগুলো নিজেদের লোক দিয়ে সাজানো, পকেটস্থ সিন্ডিকেট করা ইত্যাদি আমরা বুঝতে পেরেছিলাম পরিস্থিতি খুব নাজুক। তাই আমরা উপাচার্য পদত্যাগের আন্দোলন করেছিলাম। এখন যেহেতু একটার পর একটা অনিয়ম বের হয়ে আসছে তা স্পষ্টভাবে আমাদের কার্যক্রমের যথার্থতা প্রমাণ করে।
সূত্রঃ পূর্বকোণ