জনপ্রতিনিধিরা মামলার জালে, সীমাহীন ভোগান্তি বাসিন্দাদের
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবু তাহের। তাঁর জরুরি দরকার একটি ওয়ারিশান (উত্তরাধিকার) সার্টিফিকেট। বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুরছেন ইউপি কার্যালয়ের দ্বারে দ্বারে। কিন্তু একদিকে এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার হয়েছেন, অন্যদিকে মারা গেছেন ইউপি সদস্যও। তাই প্রতিদিন ভোগান্তি সয়েও পাচ্ছেন না কাঙ্খিত সেবা।
শুধু খৈয়াছড়ার আবু তাহের নন, তাঁর মতো এরকম আরও অনেক সেবাপ্রার্থী ঘুরছেন এই উপজেলার বিভিন্ন ইউপি কার্যালয়ে। কিন্তু দিনশেষে সেবা ছাড়াই রিক্ত হাতে ফিরতে হচ্ছে ঘরে। স্থানীয়দের অভিযোগ— উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র একের পর এক মামলায় জড়াচ্ছেন। আর এসব মামলায় অধিকাংশ সময় ব্যয় করছেন শহরের আদালতে। তাই জনপ্রতিনিধি থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন মানুষ ইউনিয়ন পরিষদে এসে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। ইউনিয়নের সাপ্তাহিক গ্রাম আদালত, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং নাগরিকদের জন্মনিবন্ধন, নাগরিক সনদ, চারিত্রিক সনদসহ বিভিন্ন প্রকার সার্টিফিকেট প্রদান, ট্রেডলাইসেন্স, বিভিন্ন ভাতা ভোগীদের ভাতা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে।
মিরসরাই উপজেলয়ায় মোট ইউনিয়ন আছে ১৬টি এবং পৌরসভা দুটি। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ১২ নম্বর খৈয়াছড়া, ১১ নম্বর মঘাদিয়া, ১৩ নম্বর মায়ানী, ৪ নম্বর ধুম ইউনিয়ন, ১ নম্বর করেরহাট ও বারইয়ারহাট পৌরসভার বাসিন্দারা জনপ্রতিনিধিদের কাছে পাচ্ছেন না প্রয়োজনের সময়।
জানতে চাইলে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজা জেরিন বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা ইউনিয়নের সরকারি বিভিন্ন সেবা ও উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত। এ ক্ষেত্রে তাদের অনুপস্থিতিতে নাগরিক সেবা বিঘ্ন হয়। সেবাপ্রত্যাশীরা দুর্ভোগে পড়েন।’
জানা গেছে, গত ১৬ মে মিরসরাই উপজেলার ১২ নম্বর খৈয়াছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক জুনুকে বড়তাকিয়া বাজার থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বনানী থানা পুলিশ। ১৭ মে ঢাকা মেট্রোপলিটন জজ আদালতে তাকে হাজির করা হলে বিচারকের নির্দেশে ঢাকার কেরানিগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়।
গত ২২ এপ্রিল ঢাকার বনানী থানার পার্ক-সংলগ্ন এলাকায় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সভাপতি আছিফুর রহমান শাহীনকে হত্যার উদ্দেশে হামলার ঘটনায় চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক জুনুকে প্রধান আসামি করে ঢাকা মহানগর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট তৃতীয় আদালতে মামলা করা হয়। এই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০২৩ সালের ১৭ জুন শিল্পজোন সড়কে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ এলিটের গাড়ি বহরে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মিরসরাই থানায় ১১ নম্বর মঘাদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন মাস্টারকে প্রধান আসামি করে ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
গত ৩ এপ্রিল ১৩ নম্বর মায়ানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবির আহম্মদ নিজামীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রট নাজমুন নাহার। চেয়ারম্যান কবির আহম্মদ নিজামীকে প্রধান আসামি করে আরও ১২ জনের বিরুদ্ধে এই মামলাটি করেন পশ্চিম মায়ানি গ্রামের হারুনা বেগম (৭৯) স্বামী নুরুল আলম।
মামলার বিবরণে জানা যায়, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্প এলাকায় বাদিনীর দাদা মোহাম্মদ আকরম আলী ওরফে রেদোয়ান পিতা আবদুল খালেক এর ৮.৭০০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মোহাম্মদ রেদোয়ানের একমাত্র ওয়ারিশ ছিলেন মো. এছহাক। এক নম্বর আসামি চেয়ারম্যান কবির আহম্মদ নিজামী অপরাপর আসামিদের যোগসাজসে গত ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ সালে একটি ভুয়া ওয়ারিশ সনদ ইস্যু করেন। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ওয়ারিশ সনদ ইস্যু করে নামজারি খতিয়ান সৃজনের মাধ্যমে এলএ শাখা চট্টগ্রাম থেকে পাঁচ কোটি ৫৩ লাখ ৪২ হাজার ৯৩৯ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করার অপরাধে চেয়ারম্যান কবির আহম্মদ নিজামীসহ মামলার অপরাপর আসামিদের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ২০ জুলাই সিআইডি এবং পিবিআই মামলাটি তদন্ত করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। আদালত তদন্ত আমলে নিয়ে আসামি গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করার জন্য সমন জারি করেন।
১ নম্বর করেরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন পদত্যাগ করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইউপি সদস্য মো. মহিউদ্দিন। আগামী জুলাই মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চেয়ারম্যান না থাকায় উন্নয়ন প্রকল্প ও পরিষদের বিভিন্ন নাগরিক সেবায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নাগরিকরা।
৪ নম্বর ধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর ভুঁইয়া প্রথমধাপে অনুষ্ঠিত মিরসরাই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের একটি সমাবেশে দলের গঠনতন্ত্র বিরোধী বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে এলাকায় নিজের দলের লোকদের কাছে সমালোচিত হন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিষ্টার বিপ্লব বডুয় গত ১৫ মে পনেরো দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য নোটিশ করেন।
চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর ভুঁইয়া বলেন, ‘এমপির পছন্দের প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করায় আমি এবং আমার পরিষদের মেম্বার কেউ এলাকায় থাকতে পারছে না। সাইফুল ইসলাম নামে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের একজন ইউপি সদস্যের ঘরে ঢুকে হামলা চালিয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের উন্নয়নকাজ ব্যাহত হচ্ছে এবং নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সেবা গ্রহিতারা।’
বারইয়ারহাট পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম খোকনের বিরুদ্ধে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর ১ বছরের সাজার রায় ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে মোহাম্মদ রেজাউল করিম খোকনের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৪২৭ ধারায় আনা অভিযোগ সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। অনাদায়ে আসামিকে আরও ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। আসামি পলাতক থাকায় একই রায়ে তার বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হয়।
চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলায় গত ১৭ এপ্রিল মেয়র রেজাউল করিম খোকনের বিরুদ্ধে মামলার রায়ের নথি ও ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাবনা চেয়ে একটি চিঠি ইস্যু করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব আব্দুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে চলতি বছরের ১০ মার্চ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে বারইয়ারহাট পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম খোকনের বিরুদ্ধে আদালতে দায়ের করা সিআর মামলা নম্বর ১৩৬/ ২০২১ এর সর্বশেষ অবস্থা উল্লেখসহ আদেশের সার্টিফাইড কপি প্রেরণের অনুরোধ করা হয়।