জনপ্রিয় হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ‘স্বল্প খরচে’ পর্যটন সেবা
অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম। যেখানে একত্রে সবুজঘেরা পাহাড়, নদী আর সাগরের মেলবন্ধনের দেখা মেলে।
দেশের অন্যতম পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে চট্টগ্রাম যেমন সুপরিচিত, তেমনি এটি দেশের বানিজ্যিক রাজধানীও বলা যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি চট্টগ্রামকে রূপের রানিতে পরিণত করেছে।আর তাই বঙ্গোপসাগর পাড়ের এ অঞ্চলটি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।
পর্যটন প্রেমিদের এ আকর্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে চালু করা হয় পর্যটন সেবা। স্বল্প খরচে চট্টগ্রামের বেশকিছু দর্শনীয় স্থান দেখে আসা যায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে। সরকারি কোনো বরাদ্দ ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে এ সেবাটি। বর্তমানে যা একটি লাভজনক খাতে পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক হিসেবে অনেকেই তো দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্বে আসার পর সময়ে-সময়ে জেলা প্রশাসকরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে পাল্টে দিয়েছিলেন চট্টগ্রামে চিত্র। আবার কিছুকিছু উদ্যোগ সফল না হওয়ায় আলোর মুখ দেখেনি অনেক প্রকল্প।
চট্টগ্রামের বর্তমান জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি পর্যটন সেবাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। গত দুই বছর পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করতে নিয়েছেন নানান উদ্যোগ। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক সব স্থাপনা দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন পর্যটন প্রেমিদের।
শুধু তাই নয়, সমন্বিত পর্যটন সেবার আওতায় চালু হওয়া পর্যটক বাস সার্ভিস ও ফুল ডে ট্যুর সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকে এখনো তা সফলতার সঙ্গে চলছে। পর্যটক বাস সার্ভিস চালু হয় গত বছরের ১০ জুন এবং ফুল ডে ট্যুর সার্ভিস চালু হয় ১ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকে সেবাটি চট্টগ্রামসহ সারাদেশে মানুষের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
জেলা প্রশাসন সুত্রে জানা যায়, এ সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধুমাত্র পর্যটক বাস সার্ভিস থেকে আয় হয়েছে প্রায় ২২ লক্ষ টাকা। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা আয় হয়েছে। সেবা দুটি পরিচালনার জন্য সরকারের কোনো আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হয় না। বরং এ বাস সার্ভিসের আয় থেকেই বিভিন্ন খাতের ব্যয় মেটানো হচ্ছে। সেবা দুটির পরিধি আরও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
শিক্ষার্থী সোহরাব হোসেন সাহল প্রায় সময় ঘুরতে যাওয়ার জন্য বাবার কাছে বায়না ধরতেন। সন্তানের আবদার মেটাতে স্বল্প খরচে পুরো পরিবার নিয়ে একদিনের ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন মোহাম্মদ শফি। এর মাঝেই খোঁজ পান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে চালু হওয়া ফুল-ডে সার্ভিসের। নগরের নিউমার্কেটের মোটেল সৈকত থেকে যাত্রা শুরু করে সীতাকুণ্ডের মহামায়া লেক, সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক, গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত, ফৌজদারহাট ডিসি পার্ক ঘুরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হয়ে দিনে দিনে আবার মোটেল সৈকতে ফিরে আসেন তারা। একদিনেই চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার সুযোগ হয় সবার।
এভাবেই প্রতি শুক্র ও শনিবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে চালু হওয়া এ পর্যটন সেবা নিতে মুখিয়ে থাকেন নগরের হাজারো পর্যটন প্রেমী মানুষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সাদাফ খান বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রামে পর্যটনশিল্প বিকাশের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা খুব একটা সামনে এগিয়ে যেতে পারিনি। এ খাত থেকে সরকারের বিপুল অর্থ আয়ের সম্ভাবনা থাকলেও বরাবরই তা উপেক্ষিত। কিন্তু চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি কোনো বরাদ্দ ছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে পর্যটনপ্রেমী মানুষদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন।
জেলা প্রশাসনের ছাদখোলা পর্যটক বাস:
চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের অন্যতম নান্দনিক ও জনপ্রিয় সৈকতগুলোর মধ্যে অন্যতম। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নান্দনিকভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে এই সমুদ্র সৈকতটির জনপ্রিয়তা পর্যটকদের কাছে দিনদিন বাড়ছে। কর্ণফুলী নদী ও সাগরের মোহনায় অবস্থিত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বিকেল এবং সূর্যাস্তের সময় পর্যটকের ঢল নামে। এছাড়া, চট্টগ্রাম শহরের ফৌজদারহাটে অবস্থিত জেলা প্রশাসন কর্তৃক নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ‘ডিসি ফ্লাওয়ার পার্ক’ ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে এসব আকর্ষণীয় স্থান গুলোতে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য নির্ভর করতে হয় গণপরিবহন কিংবা উচ্চ ভাড়ায় চালিত পরিবহনের ওপর। ফলে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকরা তো বটেই চট্টগ্রামের ভ্রমণ পিপাসুদের নানান ভোগান্তির শিকার হতে হয়। পর্যটকদের ভোগান্তি কমাতে এবং নিরাপদ ভ্রমণের জন্য প্রথমবারের মতো বিশেষ ‘ছাদখোলা’ বাস চালুর উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা পর্যটনপ্রেমীদের ডিসি পার্ক ও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে দুটি ডাবল ডেকার (একটি ছাদখোলা) বাস দিয়ে পর্যটক বাস সার্ভিস চালু করেছি। একই সঙ্গে মাইক্রোবাস এর মাধ্যমে ‘হাফ ডে এবং ফুল ডে ট্যুর সার্ভিস’ চালু করেছি। ভবিষ্যতে আনোয়ারার পারকি সমুদ্র সৈকত, ইউরোপীয়ান ক্লাব, বাটালী হিলসহ অন্যান্য জায়গায়ও এই সার্ভিস চালু করবো। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এবং ফৌজদারহাট ডিসি পার্কের গমনাগমন নির্বিঘ্ন ও সহজতর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের সহযোগিতায় টাইগার পাস থেকে পর্যটক বাস দুটি চালু করেছি।
সার্ভিসটি প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টা, বিকাল ৩টা, বিকাল ৪টায় মোট ৩টি ট্রিপ পরিচালনা করে। এছাড়া প্রতি শনিবার চলে ৪টি ট্রিপ। ট্রিপগুলো যথাক্রমে সকাল সাড়ে ৯টা, সকাল সাড়ে ১০টা, বিকাল ৩টা ও বিকাল ৪টায় যাত্রা করে। এছাড়া রোববার থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন ২টি ট্রিপ যথাক্রমে বিকাল ৩টা ও বিকাল ৪টায় চট্টগ্রামের টাইগারপাস থেকে পতেঙ্গার উদ্দেশে যাত্রা করে।
শুক্রবার তিনটি ট্রিপ যথাক্রমে দুপুর ১২টা, সন্ধ্যা ৭টা, রাত ৮টা, শনিবার চারটি ট্রিপ যথাক্রমে দুপুর ১টা, দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৭টা, রাত ৮টায় পতেঙ্গা থেকে একই রুটে ফিরে আসে। পর্যটক বাস সার্ভিসে ভ্রমণের জন্য নিউমার্কেট থেকে ডিসি পার্ক ৪৫ টাকা, ডিসি পার্ক থেকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ৩০ টাকা, টাইগারপাস থেকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ৯০ টাকা করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। একইভাবে পতেঙ্গা থেকে ডিসি পার্ক ৩০ টাকা, ডিসি পার্ক থেকে টাইগারপাস ৪০ টাকা, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে টাইগারপাস ৯০ টাকা টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
‘ফুল ডে ট্যুর সার্ভিস’:
পর্যটক বাস চালুর পর এবার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান চালু করেছেন ‘ফুল ডে ট্যুর সার্ভিস’। ইতোমধ্যে এই সার্ভিস ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সপ্তাহে দুইদিন শুক্র ও শনিবার জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় দিনব্যাপী এ কার্যক্রমে ভ্রমণ পিপাসুদের দিনদিন আগ্রহ বাড়ছে। এতে দুপুরের খাবারসহ যাত্রী প্রতি খরচ পড়ছে ৯০০ টাকা।
শুক্র ও শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের স্টেশন রোড এলাকায় মোটেল সৈকত থেকে ৪টি মাইক্রোবাসে করে ৪০জন যাত্রী নিয়ে ফুল ডে ট্যুর সার্ভিসের যাত্রা শুরু করে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক বলেন, চট্টগ্রামের পর্যটন খাতকে আরও সমৃদ্ধ করতে প্রথমবারের মতো ‘হাফ ডে ও ফুল ডে ট্যুর সার্ভিস’চালু করেছি। প্রাথমিকভাবে এই উদ্যোগ কেমন হবে সেটা নিয়ে আমি খুব সংকিত ছিলাম। চালুর পর দেখলাম এই উদ্যোগে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। দিনদিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এ কার্যক্রম আমরা হাতে নিয়েছি সেবার জন্য, ব্যবসার জন্য নয়।
হাফ ডে ও ফুল ডে ট্যুর সার্ভিসে মোটেল সৈকত থেকে যাত্রীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে মহামায়া লেক হয়ে সীতাকুণ্ডের ইকোপার্ক। পার্কের ভিতরে থাকা সহস্রধারা ও সুপ্তধারা দুটি ঝরনা দেখে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত হয়ে ফৌজদারহাট ডিসি পার্ক ভ্রমণ, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হয়ে আবার মোটেল সৈকতে ফিরে আসে। ভবিষ্যতে আনোয়ারার পারকি সমুদ্র সৈকত, ইউরোপীয়ান ক্লাব, বাটালী হিলসহ অন্যান্য জায়গায়ও এই সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) তানভীর-আল-নাসীফ বাংলানিউজে বলেন, পর্যটন খাতকে আরও সমৃদ্ধ করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে৷ পাহাড়, নদী, সমুদ্র আর সবুজ বনাঞ্চলে সমৃদ্ধ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম দেশের অন্যতম পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে সুপরিচিত। এখানে অবস্থিত পতেঙ্গা সৈকত বাংলাদেশের অন্যতম নান্দনিক ও জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকতগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমরা এ সম্ভাবনাময়ী পর্যটন খাতকে কাজে লাগাতে চাই। যার জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মহোদয় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে চট্টগ্রামের চিত্র।