জালিয়াতি ধরা পড়ার পরও বুক ফুলিয়ে ঘুরছেন ওসমান
নাম ওসমান আলী। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার কেওচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তিনি। এ ছাড়াও তিনি উত্তর সাতকানিয়া সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। এলাকায় ভীষণ দাপট তার। হেন কোনো কাজ নেই যা তিনি পারেন না।
সম্প্রতি বিএস সংশোধনের একটি মামলায় আলোচনায় আসেন ওসমান চেয়ারম্যান। বাদীর অজান্তে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে আরেকজনকে ভুয়া বাদী সাজিয়ে প্রত্যাহার করা হয় মামলা। যার নেপথ্যে রয়েছেন ওসমান চেয়ারম্যান। বিষয়টি ধরা পড়লে খোদ আদালতের নাজির বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু এরপরও ঠেকানো যায়নি প্রভাবশালী এ চেয়ারম্যানকে। এখনো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ওসমান চেয়ারম্যান।
স্বাক্ষর জালিয়াতির ঘটনায় গত ২৬ এপ্রিল কেওচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওসমান আলী ও আজিজুল হকের বিরুদ্ধে সাতকানিয়া থানায় মামলা করেন সাতকানিয়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের নাজির মোহাম্মদ আবদুল হান্নান।
বৃহস্পতিবার (২ মে) দুপুরে চট্টগ্রাম সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসেন জুনায়েদের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন ওসমান আলী। শুনানি শেষে আদালত তা মঞ্জুর করেন।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী শুভ্র প্রকাশ দে ও চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা কোর্ট ইন্সপেক্টর মাহবুব মিল্কি এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
এদিকে কোন অদৃশ্য শক্তিতে বীরদর্পে এখনো এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন ওসমান! খোদ আদালত বাদী হয়ে মামলা করার পরেও হাওয়াতে জামিন নিয়েছে কীভাবে– তা নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে এলাকায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দারা কালবেলাকে বলেন, জায়গা-জমি দখল থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা তিনি পারেন না। ইউপি চেয়ারম্যান ওসমান আলী প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের কেঁওচিয়া চেয়ারম্যান পাড়া এলাকার বাসিন্দা নুরুল আমিন নামে এক ব্যক্তিসহ ১৯ জন ব্যক্তি তাদের জায়গার ভুল বিএস সংশোধনের জন্য সাতকানিয়া যুগ্ম জেলা জজ আদালতে একটি মামলা করেন। ২০২১ সালে মামলাটি সাতকানিয়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে বদলি করা হয়। এরপর ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে (এলএসটি) এটি তালিকাভুক্ত হয়। এ মামলার বিষয়টি ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ৩০ ধারার জন্য তদবিরের দিন ধার্য ছিল।
পরে ৩১ জানুয়ারি মামলাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অথচ বাদী পক্ষের আইনজীবীই বিষয়টি জানতেন না। মামলার বাদী মো. বেলালসহ রহিম বকসু ও মোজাফ্ফর আহমদ নামে দুইজন মৃত ব্যক্তি এবং এক প্রবাসীর স্বাক্ষর জালিয়াতি করে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছিল। প্রকৃত বাদীরা বিষয়টি জেনে ১১ মার্চ আগের আদেশ এবং মামলার নম্বর বহাল রাখতে আদালতে আবেদন করেন।
বিষয়টি তদন্ত করে আদালত বাদী-বিবাদীর উপস্থিতিতে ২৫ এপ্রিল শুনানির দিন ধার্য করে। এদিন সাতকানিয়া সিনিয়র সহকারী জজ শরিফুল হকের আদালতে জবানবন্দি দেন আজিজুল হক (৫৬)। সাক্ষর জালিয়াতির সঙ্গে দুজনের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় আদালত।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাতকানিয়া থানার করা মামলা নথি সূত্রে জানা যায়, বিএস সংশোধনের মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য গত ৪ এপ্রিল আদালতে আবেদন করা হয়। ওই আবেদনে প্রকৃত বাদী মো. বেলালের স্বাক্ষর ছিল না। এজলাস চলাকালে বিষয়টি বুঝতে পারে আদালত।
এ বিষয়ে আইনজীবীর সহকারী (ক্লার্ক) নেজাম উদ্দীন জানান, আজিজুল হক নামে এক ব্যক্তির অনুরোধেই আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি আবেদনটি ফাইল করেন। ২৫ এপ্রিল সেই আজিজুল হককে আদালতে হাজির করানো হয়। মামলার প্রকৃত বাদী মো. বেলালও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বেলাল জবানবন্দিতে জানান, মামলা প্রত্যাহারের আবেদনে করা স্বাক্ষরগুলো তার নয়। অপরদিকে, জবানবন্দিতে অভিযুক্ত আজিজুল হক কেওচিয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ওসমান আলীর নির্দেশেই মামলা প্রত্যাহারের আবেদন ও একটি আপসনামা আদালতে জমা দেন বলে স্বীকার করেন।
এদিকে আদালত বাদীর আর্জি, জাতীয় পরিচয়পত্র, মামলা প্রত্যাহারের আবেদন ও জবানবন্দিতে দেওয়া স্বাক্ষরগুলো তুলনা করেন। এতে, স্বাক্ষর জালিয়াতি ও প্রতারণায় আজিজুল হক ও ওসমান আলীর জড়িত থাকার প্রমাণ পান আদালত। পরে এজলাসে থাকা অবস্থায় আজিজকে আটক করা হয়।
চট্টগ্রাম আদালতের বিজ্ঞ আইনজীবীরা বলেন, ভুয়া ব্যক্তিকে বাদী সাজিয়ে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করা- এ যেন বিজ্ঞ আদালতের সঙ্গেই আয়নাবাজি করা যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আসামিপক্ষের আইনজীবী বেলাল বলেন, বৃহস্পতিবার (২ মে) আত্মসমর্পণপূর্বক জামিনের প্রার্থনা করলে আদালত তা মঞ্জুর করে মামলার দুই নম্বর আসামি ওসমান আলীকে জামিন দেন।