জাহাজের এক ধাক্কায় দুমাস পিছিয়ে গেল সংস্কার
‘বার্ধক্যের রোগ’ সারিয়ে জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতুতে গাড়ি চলাচল শুরু করা নিয়ে সময়সীমা কোনোভাবেই ঠিক থাকছে না। সর্বশেষ বলা হয়েছিল গেল এপ্রিলে সংস্কারকাজ শেষ হবে। এপ্রিল শেষে এখন মে মাস। সম্প্রতি সময় পেছানোর কারণ হিসেবে নতুন করে যুক্ত হলো সেতুর দুটি স্প্যানে লাইটার জাহাজের ধাক্কা! এতে সংস্কার পিছিয়ে যাচ্ছে আরও দুই মাস। আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বললেও শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কথা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে আসন্ন কোরবানি ঈদের আগেই যানবাহন চলাচল শুরু হবে কালুরঘাট সেতুতে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, গত সপ্তাহে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখীর তাণ্ডবে কালুরঘাট সেতুর ৯ ও ১০ নম্বর স্প্যানে কর্ণফুলী নদীতে নোঙর করা একটি লাইটার জাহাজ বেপোরোয়া গতিতে ধাক্কা দেয়। এতে সেতুর আন্ডার স্ল্যাং গার্ডার, ওয়াকওয়ে ও রেলিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা সারাতে আরো মাস খানেক সময় লাগবে। সব মিলিয়ে পুরো সংস্কারকাজ শেষ করে গাড়ি চলাচল শুরু করতে দুই মাস লেগে যেতে পারে।
রবিবার (১২ মে) সন্ধ্যায় সিভয়েস২৪কে এমনটি জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সেতু প্রকৌশলী জিসান দত্ত। এক প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী জিসান বলেন, ‘কোন দিন থেকে গাড়ি চলবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, জুন-জুলাই থেকে গাড়ি চলতে পারে।’
এদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য (চট্টগ্রাম-৮) আবদুচ ছালাম সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কথা হয়েছে। শিগগিরই সংস্কারকাজ শেষ হবে। কোরবানির ঈদের আগেই সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।’
দফায় দফায় পেছাচ্ছে সংস্কারকাজ
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরুর আগে বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল শতবর্ষী জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু। ‘বার্ধক্যের রোগ’ সারাতে ২০২৩ সালের ১ আগস্ট থেকে সেতুর ওপর যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে। শুরুতে তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে যানচলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে ৫ নভেম্বর কক্সবাজারের পথে ট্রেন চলাচল শুরু করে দেওয়া হয়। এরপর দফায় দফায় ঘোষণা দিয়েও সেতুটি যানচলাচলের উপযোগী করে তুলতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। ৯ মাস পেরিয়ে গেলিয়ে এটি নিয়ে খুব একটা ‘মাথাব্যথা’ দেখা যাচ্ছে না সংস্থাটির কর্তাব্যক্তিদের।
এ প্রসঙ্গে ভোক্তাদের জাতীয় সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘সময়ক্ষেপণ করা মানে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেওয়া। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা উচিত। তারা যদি এভাবে কাজের সময় বাড়াতেই থাকে; তাহলে মানুষের দুর্ভোগের পাল্লাও বাড়বে। এছাড়া সময় যেভাবে বাড়বে তেমনি খরচও বাড়বে।’
‘এ প্রকল্পের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তারা যদি সঠিক সময়ে কাজ শেষ না করেন; তাহলে জনগণের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি রাষ্ট্রের-সরকারেরও লোকসান হচ্ছে। কেননা, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়া মানে খরচ বেড়ে যাওয়া’ —যোগ করেন নাজের হোসাইন।
সেতুর সংস্কারে জোড়াতালির কাজেও ঠিকমতো যোগান দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন কালুরঘাট সেতুর দাবিতে আন্দোলনকারীরা। তারা বলছেন, সেতু নির্মাণে যেমন দীর্ঘসূত্রতা, সংস্কার কাজেও ঠিক তেমনি দীর্ঘসূত্রতা।
বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোমিন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমরা নতুন সেতু নির্মাণের জন্য আন্দোলন করেছি। সেই দাবি পাশ কাটিয়ে রেলওয়ে জোড়াতালির কাজ শুরু করেছে। তাতেও ঠিকমতো যোগান দিচ্ছে না। দিনের পর দিন কাজ পেছাচ্ছে। এতে সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে। বিকল্প হিসেবে যে ফেরি দেওয়া হয়েছে তাতেও কম ভোগান্তি নেই। প্রাণহানিসহ দুর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ।’
জানা গেছে, কালুরঘাট সেতুর বিকল্প হিসেবে বর্তমানে দেওয়া হয়েছে তিনটি ফেরি। এর মধ্যে একটি বিকল। বাকি দুটির মধ্যে প্রায় সময় অচল হয়ে পড়ে একটি। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় দুপারের চালক-যাত্রীদের। এপার থেকে ওপারে যেতে যেমন সময় বেশি লাগে, ঠিক তেমনি রোদ বৃষ্টিতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
২০১০ সালে তৃতীয় শাহ আমানত সেতু উদ্বোধনের আগ পর্যন্ত কালুরঘাট সেতু দিয়ে ভারী যান চলাচলের কারণে সেতুটি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। ২০০১ সালে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর ২০০৪ ও ২০১২ সালে দুদফা সেতু বন্ধ রেখে সংস্কার করেছিল রেল কর্তৃপক্ষ। সেই সময়ও অন্যান্য যানবাহন পারাপারের জন্য ফেরি চালু করা হয়েছিল।
সংস্কারকাজ আর দীর্ঘায়িত না করে যতদ্রুত সম্ভব সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের নেতা মোমিন বলেন, ‘সংস্কারকাজের মেয়াদ যাতে বারংবার পরিবর্তন করে দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে আর ফেলা না হয়। পাশাপাশি নতুন সেতু নির্মাণের বিষয়ে ত্বড়িৎগতিতে অগ্রসর হতে হবে সরকারকে। এতে বোয়ালখালীবাসীর দীর্ঘদিনের আক্ষেপ ঘুচবে।’
১৯৩০ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হয় ৭০০ গজ দীর্ঘ কালুরঘাট রেল সেতু। ১৯৫৮ সালে এ সেতু সব ধরনের যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।
১৯৯০ এর দশকে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে ট্রেন চলাচল সীমিত হয়ে পড়লে কালুরঘাট সেতুতে যান চলাচলে চাপ বাড়ে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতু ভেঙে গেলে কালুরঘাট সেতু হয়ে পড়ে বন্দরনগরীর সাথে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ছয় উপজেলা ও কক্সবাজার-বান্দরবান জেলার যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম।