চট্টগ্রামবন্দর

জাহাজে ওঠার পর সিদ্ধান্ত হল ‘সুগন্ধি চাল’ রপ্তানি হবে না

জাহাজে ওঠার পর সিদ্ধান্ত হল ‘সুগন্ধি চাল’ রপ্তানি হবে না

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে গত জুলাইয়ে নতুন করে সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি পেয়ে ব্যবসায়ীরা বিদেশি আমদানিকারকদের কাছ থেকে কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) নিলেন, অগ্রিম দাম হিসেবে ডলারেরও একটা অংশ পেলেন। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাল পাঠাতে হবে। তা না হলে বিদেশে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়ে বাজার নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে শেষ পর্যন্ত সেই শঙ্কাই দেখা দিয়েছে।

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত জুলাইয়ে সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দেয়। এরপর সেপ্টেম্বরে খাদ্য মন্ত্রণালয় রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানায়। আর অক্টোবরে এসে কৃষি মন্ত্রণালয়ও রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয়। দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ করা হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, এসিআই ফুডস, প্রমি অ্যাগ্রো ফুডস, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজসহ ৩৩টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।

রপ্তানি অনুমতি দেওয়ার জন্য কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বিএপিএ) তিন মন্ত্রণালয়েই দৌড়ঝাঁপ করছে। বিএপিএ গত সাত দিনে বাণিজ্য, খাদ্য ও কৃষি—এ তিন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের কাছে আলাদাভাবে আবেদন করেছে।

মো. ইকতাদুল হক, বিএপিএর সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘হঠাৎ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় বিদেশি আমদানিকারকদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করেছে। জাহাজে পণ্য ওঠে গেছে, যার মধ্যে সুগন্ধি চালের পাশাপাশি অন্য পণ্যও আছে। এ অবস্থায় সরকারের মনোভাবে বিশ্ববাজারে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’

২৩ অক্টোবর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে দেওয়া আবেদনে বিএপিএ বলেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে অনুমতি পাওয়ার পর বিএপিএর বেশ কিছু সদস্য প্রচুর ক্রয়াদেশ পেয়েছে এবং তার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহও করেছে। এ জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফাইটোস্যানিটারি সনদ ইস্যু করেছে এবং এর বিপরীতে পণ্যও জাহাজীকরণ হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সনদ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ হিসেবে অধিদপ্তর বলছে, গত ১০ সেপ্টেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয় এবং ৮ অক্টোবর খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

বিএপিএর সাধারণ সম্পাদক মো. ইকতাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় বিদেশি আমদানিকারকদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করেছে। জাহাজে পণ্য ওঠে গেছে, যার মধ্যে সুগন্ধি চালের পাশাপাশি অন্য পণ্যও আছে। এ অবস্থায় সরকারের মনোভাবে বিশ্ববাজারে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’

জানা গেছে, খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ১৮ অক্টোবর বিএপিএর সদস্যরা সচিবালয়ে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি সুগন্ধি চালসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ নেবেন বলে আশ্বাস দেন এবং কী পরিমাণ রপ্তানি বাকি আছে, সেই তালিকা চান। খাদ্যমন্ত্রীর চাওয়া অনুযায়ী তাঁর দপ্তরে তালিকা পাঠিয়েছে বিএপিএ।

রপ্তানি অনুমতি ও বাতিলের কাহিনি

রপ্তানি নীতি আদেশ অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে সব সময়ই চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ। তবে সরকারের অনুমতি নিয়ে সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের ২৪ হাজার ৪১৭ টন চাল রপ্তানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি বন্ধ করা হয়। তত দিনে ৩ হাজার ২৪৪ টন সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়েছে। তবে ২১ হাজার ১৭৩ টন চাল রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেনি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।

রপ্তানিকারকেরা গত জানুয়ারিতে আবার নতুন করে অনুমতি চায়। গত ৩০ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আবার আগের প্রতিষ্ঠানগুলোকেই সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দেয়। তবে মন্ত্রণালয় জানায়, আগের অনুমতির যে পরিমাণ চাল রপ্তানি হয়নি, সেটাই শুধু রপ্তানি করা যাবে। সেই সঙ্গে ২০২৪ সালের ৩০ জুনের মধ্যে সেগুলো রপ্তানির শর্ত দেয়।

এদিকে ৮ অক্টোবর খাদ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘দেশের সার্বিক খাদ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় সুগন্ধি চালসহ যেকোনো প্রকার চাল রপ্তানি বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।’ দুদিন পর ১০ অক্টোবর কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আরেক বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে চাল/সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ করতে হবে।’

রপ্তানিকারক প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন)

কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘সরকারের অনুমোদন পাওয়ার পরই আমরা সুগন্ধি চালের সঙ্গে শর্ষে, চানাচুর, বিস্কুটসহ অন্যান্য পণ্যের বিপরীতে আমদানিকারকদের কাছ থেকে অগ্রিম ডলার নিয়েছি। জাহাজে যখন পণ্য বোঝাই হয়ে গেছে, তখন বলা হচ্ছে রপ্তানি বন্ধ। আমরা কোথায় যাব?’

সুগন্ধি চাল রপ্তানির চিত্র

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বছরে সুগন্ধি চাল উৎপাদিত হয় ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। প্রতিবছর গড়ে রপ্তানি হয় ১০ হাজার টন। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে এই চাল রপ্তানি করে আসছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ সুগন্ধি চাল রপ্তানি শুরু করে। প্রথম বছর ৬৬৩ টন সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়। পরের বছরগুলোতে রপ্তানি বাড়তে থাকে, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ হাজার ৮৭৯ টনে উন্নীত হয়।

কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, আপাতত সুগন্ধি চাল রপ্তানির কথা ভাবা হচ্ছে না। কারণ, যেকোনো ধরনের চাল রপ্তানিই চালের দাম বাড়ার কারণ বলে সরকারের নজরে এসেছে। ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করলেও সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ করেনি, এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিসচিব বলেন, ভারত ও চীন অনেক বড় দেশ। তাদের কথা আলাদা।

এদিকে রপ্তানির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d