জাতীয়

ডলার কেনাবেচায় ‘লুকোচুরি’, সংকটে বিদেশগামী সাধারণ মানুষ

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদুল ইসলাম ভারতে যাবেন। সে জন্য গত সোমবার তিনি ডলার কিনতে রাজধানীর মতিঝিলে যান। বেশ কয়েকটি মানি চেঞ্জারে গিয়ে তিনি সেগুলোর অধিকাংশই বন্ধ পান। যেগুলো খোলা ছিল, সেগুলোতে ডলার পাননি। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের আশপাশে ভাসমান অনেক বিক্রেতা তাঁর কাছে ডলার বিক্রি করতে আগ্রহ দেখান। কিন্তু দামে বনিবনা না হওয়ায় শহীদুল ডলার না কিনেই ফিরে যান।

শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েকটি ব্যাংকেও গিয়েছি। কিন্তু কোনো ডলার পেলাম না। বাইরে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা প্রতি ডলারের দাম চান ১২০ টাকা। একটু কমে কেনার জন্য বেশ কিছু মানি চেঞ্জারেও গিয়েছি। কিন্তু পাইনি।’

সেদিন মতিঝিল ও দিলকুশা এলাকায় আরও ছয়জনকে পাওয়া গেল, যাঁরা শহীদুলের মতো ডলার কিনতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাংকে ডলারের উচ্চ দাম দেখতে পান, যা মানি চেঞ্জারে আরও বেশি। আবার খুচরা বিক্রেতারা মানি চেঞ্জারদের চেয়ে কয়েক টাকা বেশি হাঁকাচ্ছিলেন দাম। ছয়জনের মধ্যে দুজন খোলাবাজার থেকে প্রতি ডলার ১১৯ টাকা ২০ পয়সায় কিনেছেন। তা–ও ডলারের নোটগুলো বেশ পুরোনো। তাই কিছুটা কম দামে পেয়েছেন তাঁরা। নোট নতুন হলে দাম ১২০ টাকার ওপরে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মানি চেঞ্জারদের জন্য ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১১৩ টাকা বেঁধে দিয়েছে। সেই দামে কোথাও ডলার বিক্রি হচ্ছে না।

এদিকে বেশি দামে ডলার বিক্রি ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন মানি চেঞ্জারে অভিযান চালায়। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে। কয়েকটির লাইসেন্সও স্থগিত করা হয়। এরপর থেকে মানি চেঞ্জারগুলোয় ডলার বিক্রি বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কিছু ভাসমান বিক্রেতার কাছে স্বল্প পরিমাণে ডলার পাওয়া যায়। অর্থাৎ খোলাবাজারে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে একধরনের ‘লুকোচুরি’ চলছে।

গত সোমবার সরেজমিনে রাজধানীর মতিঝিল–দিলকুশার মতো গুলশান এলাকা গিয়ে অধিকাংশ মানি চেঞ্জার বন্ধ পাওয়া যায়। কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও তারা ডলার নেই বলে জানায়। এমনকি অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনও করছে না এসব প্রতিষ্ঠান। শুধু তা–ই নয়, বিমানবন্দরে অবস্থিত ব্যাংক ও মানি চেঞ্জারে ডলারের আকাল চলছে। ফলে বিদেশগামীদের কেউ বিমানবন্দর থেকেও ডলার কিনতে পারছেন না।

সম্প্রতি ভারতে যাওয়া একজন প্রথম আলোকে জানান, গুলশানে বিভিন্ন মানি চেঞ্জার ঘুরে তিনি ডলার পাননি। এমনকি ভারতীয় রুপি কিনতে গিয়েও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। একই চেষ্টা করেন বিমানবন্দরে। কিন্তু সেখানেই সব চেষ্টা বিফল হয়েছে। অগত্যা বাংলাদেশি টাকা নিয়ে কলকাতায় যান তিনি। সেখানে গিয়ে টাকার বিনিময়ে ভারতীয় রুপি কিনে প্রয়োজন সারেন।

খোলাবাজারে বছরের শুরুতে কিছু ডলার মিলত। কয়েক মাস ধরে ডলার নিয়ে রীতিমতো হাহাকার চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মানি চেঞ্জারগুলোয় অভিযান চালানোয় এবং কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করার কারণে খোলাবাজার থেকে ডলার একপ্রকার উধাও হয়ে গেছে।

ঢাকার মতিঝিল ও দিলকুশা এলাকার একাধিক মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার সঙ্গে ডলার–সংকট নিয়ে কথা বলতে চাইলে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিনিধি বলেন, ‘কম দামে এখন কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি দামে ডলার কিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামে কিছুতেই বিক্রি করা সম্ভব নয়। সকালে দোকান খোলার পর থেকে পুলিশি পাহারা থাকে। তাই দোকান বন্ধ করে আশপাশে থাকি। পরিচিত কোনো ক্রেতা পেলে দরদামে বনিবনা হওয়ার পর কিছু ডলার বিক্রি করি। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায় টিকে থাকাও দুষ্কর হয়ে পড়বে।’

এ বিষয়ে মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এ কে এম ইসমাইল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানি চেঞ্জারের বাইরে এখন অনেকে হাতে হাতে ডলার বিক্রি শুরু করেছেন। এতে যত দিন যাচ্ছে, এ ব্যবসা ভাসমান ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সংকট নিরসনে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করাসহ আমরা বেশ কিছু প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দিয়েছি। সেসব প্রস্তাবের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী নির্দেশনা দেয়, সেই অপেক্ষায় আছি।’

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানি চেঞ্জারগুলো মূলত বিদেশফেরত প্রবাসী ও পর্যটকদের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছ থেকেও নগদ ডলার কিনে কয়েক টাকা বেশিতে বিক্রি করে। প্রায় দেড় বছর ধরে ডলার–সংকট চলতে থাকায় এখন ব্যাংক থেকে নগদ ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রবাসী ও পর্যটকদের কাছ থেকে মানি চেঞ্জারগুলোকে ডলার সংগ্রহ করতে হচ্ছে চড়া দামে।

এদিকে ডলার–সংকট কাটাতে প্রয়োজনে বেশি দামে হলেও প্রবাসী আয় কেনার জন্য সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক এখন প্রবাসী আয়ে ডলার কিনছে ১১৫ থেকে ১১৬ টাকায়। যদিও প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা মিলে ডলার দাম নির্ধারণ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক ও মানি চেঞ্জারের জন্য ডলারের দাম বেঁধে দেওয়া আছে। তা তদারকি করা হয়। অনিয়ম হলে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে নগদ ডলারের যে বাজার আছে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই।

খোলাবাজারে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থী, চিকিৎসা ও পর্যটনের জন্য বিভিন্ন দেশে ঘুরতে যাওয়া মানুষের মধ্যে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে এসে এ চাহিদা আরও বাড়ে। অর্থাৎ আরও কঠিন সময় আসছে।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে পড়তে যাওয়া এক শিক্ষার্থীকে মাত্র দেড় হাজার ডলার জোগাড় করতে কয়েকটি ব্যাংক ঘুরতে হয়। শেষে বহুজাতিক দুটি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ করে তিনি এক হাজার ডলার সংগ্রহ করতে পারেন।

একই অবস্থায় পড়েন গত মাসে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বেসরকারি সংস্থায় চাকরিজীবী এক দম্পতি। পরে কোথাও ডলার না পেয়ে টাকা নিয়ে কলকাতায় যান তাঁরা।

ভারতে যাওয়া আরও কিছু যাত্রী জানান, এখন অধিকাংশ মানুষই ভারতে ডলার বা রুপির বদলে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। কলকাতার কয়েকটি স্থানে অনানুষ্ঠানিকভাবে রুপি–টাকা বেচাকেনা বেশ জমে উঠেছে। তা আগেও ছিল, তবে সীমিত।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ডলার–সংকটের এ সময়ে দেশের বাইরে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন বেড়েছে। বাংলাদেশিরা গত আগস্টে দেশের বাইরে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ ৭৪ কোটি টাকা খরচ করেছেন ভারতে। এরপরই ক্রেডিট কার্ডের বেশি ব্যবহার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে।

ব্যাংকাররা বলছেন, চিকিৎসা ও পর্যটনের জন্য প্রতি মাসে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ভারতে যান। প্রচুর শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করছেন। তাই এসব দেশে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ডলার–সংকটের কারণে তা বেড়ে গেছে।

গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকে এক সভা শেষে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, খোলাবাজারে বছরে তিন থেকে চার কোটি ডলার লেনদেন হয়। দেশের অর্থনীতির যে আকার, তার তুলনায় এ লেনদেন খুবই সামান্য। ফলে কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার কত বা তাকে মানদণ্ড হিসেবে দেখানোর প্রয়োজন নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d