তামাকের বিষে নীল হালদা
তামাকের বিষ থেকে সহসা মুক্তি মিলছে না। চলতি বছরেই চট্টগ্রাম, তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান ও কক্সবাজারে তামাক চাষ হয়েছে তিন হাজার ৫৮২ হেক্টর জমিতে। এতে উর্বরতা হারাচ্ছে জমি। হালদার উৎপত্তিস্থল খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি ও রামগড়ে ব্যাপকভাবে তামাক চাষের কারণে হুমকির মুখে পড়ে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। মূলত টোব্যাকো কোম্পানিগুলো অগ্রিম টাকা ও নানা প্রলোভন দেখিয়ে চাষিদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করার কারণে এ সমস্যা থেকে মুক্তি মিলছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিসংখ্যানে জানা গেছে, চট্টগ্রামসহ ৫ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হয় কক্সবাজার জেলায়। এ জেলায় তামাক চাষ হয় প্রায় ১৬৫০ হেক্টর জমিতে। এর পরের অবস্থান বান্দরবান জেলায়। পার্বত্য এ জেলায় তামাকের চাষ হয় এক হাজার ১৯৬ হেক্টর জমিতে। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় তামাকের চাষ হয় যথাক্রমে ৪৮৬ হেক্টর ও ২২০ হেক্টর জমিতে। অপরদিকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় তামাকের চাষ হয় ৩০ হেক্টর জমিতে। যদিও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
গবেষণা ও এডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) তথ্য অনুযায়ী, তামাক চাষ কেবল খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি তা নয়। এটা জমি ও তামাক চাষির স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যেমন তামাক চাষিদের মধ্যে ৪ জনে ১ জন গ্রিন টোব্যাকো সিকনেস নামে নিকোটিন বিষক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত। তামাক পাতা নাড়াচাড়ার সময় ত্বকের মাধ্যমে নিকোটিন শোষিত হওয়ার কারণে এই রোগ হয়। এছাড়া ক্ষেতে কাজ করার সময় অজ্ঞাতসারেই একজন তামাক চাষি দিনে প্রায় ৫০টি সিগারেটের সমপরিমাণ নিকোটিন শোষণ করে থাকে।
গ্লোব্যাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়। পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরো কয়েক লাখ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তামাক অন্যান্য শস্যের তুলনায় দ্রুত মাটির পুষ্টি নিঃশেষ করে মাটিকে অনুর্বর করে ফেলে। এছাড়া তামাক চাষে অন্যান্য ফসলের তুলনায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকও বেশি ব্যবহার করতে হয়। এসব রাসায়নিক উপাদান পরবর্তীতে পানির সাথে ধুয়ে আশেপাশের নদী, খাল, জলাশয় ও খাবার পানির উৎসগুলোকে দূষিত করে। তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেশের নদী, খাল, বিল, পুকুর ও দিঘির মৎস্য উৎপাদনে। তবে আশার কথা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে তামাক চাষ বছর বছর তুলনামূলক কমে আসছে।
তারই একটি চিত্র উঠে এসেছে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলায়। ২০১৯ সালে হালদা নদীর উজানের এ মানিকছড়ি উপজেলায় মোট ১০৪ জন তামাকচাষি মোট ৪৮ দশমিক ৯ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করেন। বেসরকারি সংস্থা আইডিএফ-পিকেএসএফ’র হালদা প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রমে বিশেষ করে নিরাপদ উপায়ে নানা সবজি চাষ ও গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনে সহযোগিতা দেওয়ার ফলে এ কয় বছরের ব্যবধানে ১০৪ জন তামাকচাষী থেকে কমে ১৬ জনে এসে ঠেকেছে। এ বছর তামাকচাষ হয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে। তবে এ বছর টোবাকো কোম্পানির প্ররোচনা ও লোভনীয় অফারের ফলে আবারো হালদার উজানে তামাকচাষির সংখ্যা ১৬ জন থেকে বেড়ে ১৮ জন চলে আসে। তাতে তামাকচাষ হয়েছে ১৮ দশমিক ৬ হেক্টর জমিতে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইডিএফের নির্বাহী পরিচালক জহিরুল আলম বলেন, ‘হালদার উজানে মানিকছড়িতে তামাকচাষ কমাতে কয়েক বছর ধরে আইডিএফ কাজ করছে। তামাকচাষীদের বিকল্প আয়বর্ধক কাজ হিসেবে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধসহ নানা কাজে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। তাছাড়া সেখানে এনিমেল হেলথ সেন্টারের কার্যক্রম পরিচালনা করছে আইডিএফ। এটির কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রতিবছর ভেক্সিনেশন ক্যাম্পের আয়োজন ও চাষিদের প্রশিক্ষণসহ নানাভাবে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে তামাক চাষ বন্ধে এনজিও সংস্থা ‘ইপসা’ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইপসা’র কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. সোহাগ হোসেন বলেন, ‘কক্সবাজার জেলায় ২০১৭ সালে তামাক চাষকৃত জমির পরিমাণ ছিল ১৬৫০ হেক্টর। এর মধ্যে চকরিয়া উপজেলায় ১০৫৫ হেক্টর ও রামু উপজেলায় ছিল ৫৯৫ হেক্টর। ইপসা চকরিয়া উপজেলায় তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে বিকল্প ফসল উৎপাদন ও বহুমুখী আয়ের উৎস সৃষ্টি প্রকল্প নিয়ে ২০১৮ সালে কাজ শুরু করার ফলে ২০২৪ সালে চকরিয়ায় তামাক চাষের পরিমাণ কমে হয়েছে ৬২০ হেক্টরে। অপরদিকে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ২০১৭ সালে তামাক চাষকৃত জমির পরিমাণ ছিল ৫২০ হেক্টর। প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ২০২৪ সালে কমে হয়েছে ২৬০ হেক্টর।’