আন্তর্জাতিক

ত্রিপুরার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে যা জানালেন স্থানীয়রা

‘আমাদের বাড়িটা এলাকার সব থেকে উঁচু জায়গায়। তাই পড়শিরা সবাই আমাদের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বাড়িতেও যে জল ঢুকে যাবে, এটা কেউ ভাবতেও পারিনি,’ বিবিসি বাংলার কাছে এভাবে ত্রিপুরার বন্যা পরিস্থিতির বর্ণনা করেন ত্রিপুরার উদয়পুর শহরের সাংবাদিক আয়ুব সরকার।

সাংবাদিক আয়ুব জানান, তিনদিন ধরে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন তিনি। শুক্রবার সকালে ব্যাটারি দিয়ে চার্জ দিয়ে মোবাইল ফোন চালু করার পরে বিবিসি বাংলাকে কথাগুলো বলছিলেন ।

সাম্প্রতিক বন্যায় সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যেসব এলাকা, তার মধ্যে অন্যতম গোমতী জেলা। তারই জেলা সদর শহর উদয়পুর। বন্যায় পুরো রাজ্যে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারিভাবে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছেন দুজন।

আয়ুব সরকার বলছিলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকাল তিনটা পর্যন্ত লাগাতার ৩৮ ঘণ্টা বৃষ্টি হয়েছে এখানে। সেই পানি তো ছিলই। তারপরে ডম্বুর ড্যামের পানি ঢুকতে শুরু করে। আবার জেলার কিছু অংশে মিজোরামের দিক থেকেও পানি চলে এসেছিল। সব মিলিয়ে যে অবস্থা তা ভয়াবহ। মাত্র দুঘণ্টার মধ্যে আমাদের ঘরে চার ফুট জল জমে গিয়েছিল। রাত্রিবেলা বাধ্য হয়েই সবাইকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। নানা সময়ে আমিই এগিয়ে যেতাম মানুষজনকে রেসকিউ করতে, এবার আমি নিজেই ভিক্টিম ‘

ত্রিপুরায় সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা তারা দেখেছেন ১৯৮৩ সালে। তবে এ বছরের বন্যা তা ছাড়িয়ে গেছে। ১০ বছর পরে ১৯৯৩ সালেও বন্যা হয়েছিল। ‘কোথাও শুধু বাড়ির টিনের ছাদ দেখা যাচ্ছে, কারও বাড়ির শুধু দোতলাটা দেখা যাচ্ছে – মানে একতলা পুরো ডুবে গেছে,’ জানাচ্ছিলেন আয়ুব সরকার।

চারদিকে শুধুই পানি আর পানি
গোমতি জেলারই আরেকটি এলাকা মহারানি। সেখানকার স্থানীয় সাংবাদিক মোছলেম মিঞা শুক্রবার দুপুরে যা দেখতে পাচ্ছেন, তারই বর্ণনা দিচ্ছিলেন বিবিসিকে।

‘চারদিকে শুধুই পানি, মাঝে মাঝে কিছু মানুষের ঘরবাড়ি আর গাছপালা দেখা যায়। আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মহারানি এলাকার প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িতেই বুক সমান পানি এখন, কারও বাড়িতে দশ হাত পর্যন্ত পানি দাঁড়িয়ে আছে। গত তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই, খাওয়ার পানিও নেই। কোথাও কোনও গাড়ি চলার উপায় নেই’ বলছিলেন মোছলেম মিঞা।

তার কথায়, ‘আমাদের এই অঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস, তার ৯৫% মানুষই এখন হয় আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন। অনেকে আবার টিলা এলাকার বাড়ি বা অফিস-কাছারিগুলিতে আশ্রয় নিয়েছে।’

‘তারা কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, কেউ জানেন না। অনেকে চেষ্টা করছেন যে নৌকা বা ভেলায় চেপে নিজের বাড়ির দিকে যাওয়ার, যাতে একবার চোখের দেখা দেখে আসতে পারেন।’

তিনি জানাচ্ছিলেন ওই এলাকা এক তো গোমতি নদীর তীরে, লাগাতার বৃষ্টির কারণে সেই পানি পাড় উপচে এলাকা ভাসিয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের ডম্বুর বাঁধের পানি ঢুকে এলাকা আরও ডুবিয়েছে।

নিজে সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দুদিনের পরে তার পক্ষে পেশাগত কাজ করা আর সম্ভব হয়নি।

‘কোনওমতে নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছি। তারপরে নৌকায় করে বহু মানুষকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। এর মধ্যে আর পেশার দিকে নজর দিতে পারিনি,’ বলছিলেন মোছলেম মিঞা।

নামতে শুরু করেছে পানি
শুক্রবার সকাল থেকে নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় ত্রিপুরার অনেক এলাকা থেকেই পানি নেমে যেতে শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে। তবে গোমতি আর খোয়াই নদী দুটির জলস্তর এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়েই বইছে।

সাংবাদিক আয়ুব সরকার বলছেন, ‘এখানে সকাল থেকে জল নেমে যাচ্ছে। কিন্তু গোমতি নদীর ধারে সোনামুড়া শহরের দিকে রাত থেকে পানি বাড়ছে বলে খবর পেয়েছি। সেখানে বৃহস্পতিবার রাতেও কথা বলতে পেরেছিলাম, কিন্তু শুক্রবার সকাল থেকে আর কোনও যোগাযোগ করতে পারছি না।“

এদিকে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা শুক্রবার হেলিকপ্টারে চেপে গোমতী আর দক্ষিণ জেলায় গিয়েছিলেন। বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেওয়া পানিবন্দি মানুষের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস
রাজ্যের অনেক এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করলেও ভারতীয় আবহাওয়া বিজ্ঞান দফতর ত্রিপুরার চারটি জেলায় আগামী তিনদিন অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল সকালবেলা থেকে।

তবে দুপুরে নতুন উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে সতর্কতার মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে তারা। এখন বলা হচ্ছে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার দুটি এলাকায় আগামী দুদিন ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকলেও রাজ্যের অন্য কিছু এলাকায় শুধুই বজ্রপাতসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছে তারা।

পুরো রাজ্যে আগামী দুদিনের জন্য হলুদ সতর্কবার্তা রয়েছে শুক্রবার দুপুর থেকে। তবে রবিবার দক্ষিণ জেলার কিছু এলাকায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় সেদিন ওই অঞ্চলে লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d