দুদকের চোখে প্রভাবশালীরা: পাচারকৃত হাজার কোটি টাকার খোঁজ চলছে
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), যা এতদিন রাজনৈতিক সরকারের সময়ে নিষ্ক্রিয় বা নমনীয় হয়ে ছিল, সম্প্রতি আকস্মিকভাবে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের উৎস খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সংস্থাটি। হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচারের বিষয়েও নতুন করে অনুসন্ধান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে তারা।
এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৯ জন সাবেক মন্ত্রী ও এমপির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ২৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের গোয়েন্দা শাখায় ২ বছর আগেই সুনির্দিষ্ট তথ্য জমা ছিল। তবে তখন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ক্ষমতার পালাবদলের পরই এই ফাইলগুলো সামনে এনে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। তবে অনেকের অভিযোগ, আগে একাধিকবার পরিসমাপ্তি দিয়ে তাদের ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়েছিল।
অনেকের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুদকের এই তৎপরতা শুধুমাত্র লোক দেখানো। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দুদকের এমন কার্যকলাপ থেকে বোঝা যায় সংস্থাটি আগে থেকেই সরকারের প্রভাবাধীন ছিল। তার মতে, দুদককে ঢেলে সাজানো ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
সরকার পতনের পরপরই দুদক ৬৯ জন মন্ত্রী-এমপি, আমলা ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে। ৩১ জনের সম্পদের বিষয়ে দুদকের কাছে আগে থেকেই তথ্য থাকলেও, তা বছরের পর বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে।
অনুসন্ধান শুরু হওয়া প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় সাবেক মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী ও আমলারা রয়েছেন। ওই তালিকায় সাবেক মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন শাজাহান খান, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, গাজী গোলাম দস্তগীর, আবদুর রহমান ও জিল্লুল হাকিম। সাবেক প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন মাহবুব আলী, মেহের আফরোজ চুমকি, এনামুর রহমান, নসরুল হামিদ ও শরীফ আহমেদ।
তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান, অসীম কুমার উকিল, মানু মজুমদার, সোলায়মান হক জোয়ার্দার, ইকবালুর রহিম, রণজিৎ কুমার রায়, শফিকুল ইসলাম (শিমুল), গোলাম ফারুক, নাঈমুর রহমান (দুর্জয়), এইচ এম ইব্রাহিম, মো. সাইফুজ্জামান (শিখর), রাশেদুল মিল্লাত, হাফেজ রুহুল আমিন মাদানী, শওকত হাচানুর রহমান, আবদুল আজিজ, আনোয়ারুল আশরাফ খান, দিদারুল আলম ও এইচ বি এম ইকবাল। এ তালিকায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সরদার সাখাওয়াত হোসেনের নামও রয়েছে। এ ছাড়া প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তমাল মনসুরের নামও রয়েছে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের ওই তালিকায়। দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তাদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
১৮ আগস্ট সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে দুদক বলেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন এবং তা বিদেশে পাচার করেছেন। দুদক বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচারের টাকায় সাইফুজ্জামান ও তাঁর পরিবারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন, ফ্ল্যাট কিনেছেন। যুক্তরাজ্যে তাঁর ২০০ মিলিয়ন পাউন্ডের (৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা) সম্পদ রয়েছে বলেও দুদকের অনুসন্ধান চিঠিতে বলা হয়েছে।
দুদকের তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের একটি নির্দেশনা রয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির আয়ের উৎস, আর্থিক লেনদেন, ভিন্ন নামে করা সম্পদের তথ্য যাচাই, বাসা ও কার্যালয়ে তল্লাশি করতে হয়। এই কাজটি ঠিকভাবে হচ্ছে না। এর কারণ অনুসন্ধানের কাজে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও অনেক ক্ষেত্রেই অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না। এই অনুমতি দেওয়ার দায়িত্ব দুদক কমিশনের।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের সময় ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সংস্থাটি ক্ষমতাসীনদের খুশি করতে এবং বিরোধী দল বিএনপিকে চাপে রাখতে কার্যক্রম চালিয়েছিল। এখন আবার পরিস্থিতির পরিবর্তনে ঠিক উল্টো তৎপরতা শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বেরিয়ে না এলে দুদক দুর্নীতি প্রতিরোধে সফল হতে পারবে না।
অনুসন্ধানের তালিকায় থাকা অনেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া তালিকায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ আরও বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের নাম রয়েছে।
এছাড়া অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের পাচারকৃত অর্থের বিষয়ে তথ্য। দুদকের এই কর্মকাণ্ড কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও, সংস্থাটি ধাপে ধাপে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
তবে অনেকে আশঙ্কা করছেন, যদি ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে, তাহলে দুর্নীতিবাজরা আবারও ছাড় পেয়ে যাবেন।
এর আগে ২৯ আগস্ট রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যালয়ে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। তাঁরা দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে সমন্বয়ক সারজিস আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দুদককে বলেছি গত ১৬ বছর এই ফ্যাসিস্ট সরকার যাঁদের পছন্দ হয়নি, তাঁদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। কারও পরিবার নিয়ে সমস্যা হয়েছে, মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, কারও জমিজমা নিয়ে সমস্যা হয়েছে, মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। আর যেন এমন না হয়, সেটাই বলেছি। আর যেন কোনো রাজনৈতিক দল মিথ্যা মামলা দিয়ে কাউকে হয়রানি করতে না পারে, সেই বিষয়টি বলেছি।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতে, দুদকের সাম্প্রতিক সক্রিয়তা প্রমাণ করে যে, তারা ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত। আগের সরকারের ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকা সত্ত্বেও দুদক তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, বর্তমানে ক্ষমতাচ্যুত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান কি আসলেই তাদের সততা ও সাহসের প্রমাণ, নাকি নিজেদের দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তা ঢাকার চেষ্টা?
তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, দুর্নীতি দমনে প্রকৃত সাফল্য অর্জন করতে হলে দুদকের আমূল সংস্কার অপরিহার্য।