চট্টগ্রাম

দুশ্চিন্তা যত লবণাক্ততায়

বোয়ালখালীর কধুরখীল গ্রামের খতিবের বিল। সেচের অভাবে দীর্ঘকাল অনাবাদি পড়ে ছিল ১৫-২০ কানি ধানী জমি। ওই বিলে ৮-১০ কানি জমিতে চাষাবাদ রয়েছে স্থানীয় মোহাম্মদ শফিকের। নিজের ও বর্গা নিয়ে তাতে চাষাবাদ করে আসছেন তিনি। খতিবের বিল ছাড়াও আশপাশে আরও অন্তত ১৫-২০ কানি জমিতে চাষাবাদ করে আসছেন প্রবাসী ব্যবসায়ী শফিক। নিজ উদ্যোগে সেচযন্ত্র বসিয়ে চাষাবাদ করে আসছেন। ভালো ফসলও তুলে আসছিলেন। কিন্তু এবার ভাগ্য যেন সুপ্রসন্ন হচ্ছে না। রোপা বোরো চারা বিবর্ণ ও ফ্যাকাসে হয়ে পড়েছে। ধানের ফলন নিয়ে উদ্বিগ্ন তার চাষা আবদুল করিম।

বিলের ধারে কথা হয় আবদুল করিমের সঙ্গে। তার বাড়ি নোয়াখালীতে। শফিকের সেচযন্ত্র ও চাষাবাদ দেখাশোনা করেন তিনি। বছরজুড়ে কাজ করেন। কৃষক আবদুল করিম বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর পানিতে এবার মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা ছিল। সেচের মাধ্যমে এসব পানি জমিতে দেওয়ার পর থেকে ধানের চারা বিবর্ণ ও মরমরে হয়ে পড়ে। জমিতে লবণের আস্তরণ পড়েছে। নানা ধরনের ওষুধপত্র ছিটিয়ে চারাগুলো টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। নতুন করে আর সেচ দিচ্ছি না।’

কৃষক আবদুল করিম আক্ষেপ করে বলেন, ‘গেল বছর বোরো মৌসুমে ধানের ভালো ফলন হয়েছিল। কানিপ্রতি প্রায় ১২০ আড়ি। এবার ফলন ভালো হওয়ার আশা নেই।’

দেখা যায়, খতিবের বিলের বেশির ভাগ জমির চারা ফ্যাকাসে ও ন্যুয়ে পড়েছে। আশপাশের জমিগুলোর কিছু কিছু ছাড়াও বেশির ভাগই সবুজ-শ্যামলে ভরে রয়েছে। কোথাও কোথাও ধানের থোর দক্ষিণা বাতাসে দোল খাচ্ছে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মার্চ মাসের শুরুতে কর্ণফুলীর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেশি ছিল। এই সময়ের মধ্যে যেসব জমিতে ধান রোপণ ও সেচ দেওয়া হয়েছে সেসব জমির চারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর আগে রোপণ করা জমির চারা অনেকটা ভালো রয়েছে।

বোয়ালখালীর কধুরখীল ছাড়াও পশ্চিম গোমদণ্ডী, শাকপুরা, সারোয়াতলী ও কড়লডেঙ্গা ইউনিয়নের বেশির ভাগ জমিতে রোপা চারা মাত্রাতিরিক্ত লবণ পানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ বোরো আবাদ হচ্ছে পুরোটায় সেচনির্ভর।

বোয়ালখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ বলেন, ‘দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় খালের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে সারোয়াতলী ও কধুরখীল এলাকায় ৭-৮ একর জমির ক্ষেত সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ এই বিষয়ে পটাশ ও জিপসাম সার প্রয়োগ করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এই কৃষিবিদ বলেন, লবণাক্ততা ছাড়াও রায়খালী খালে শিল্প-কারখানার কেমিক্যালমিশ্রিত বর্জ্য ফেলার কারণে মারাত্মক পানি দূষণ হচ্ছে। লবণ ও দূষিত পানির কারণে সারোয়াতলী এলাকার চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

গত দুই বছর ধরে লবণাক্ততার কারণে বোরো আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই অঞ্চলে। গত বছর ধান কাটার আগমুহূর্তে লবণাক্ততা ও খরায় পুড়েছিল বোরো আবাদ। এই বছর রোপা বোরোতে লবণক্ততা আঘাত হেনেছে। এজন্য লবণ সহিষ্ণু জাত ব্রি-৪৭ ও ব্রি-৬৭ ধান রোপণের পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা। এছাড়াও লবণ সহনশীল ব্রি-৯২ ও ৯৬ জাতের ধানও রোপণ করা যাবে। এসব জাতের ধান চাষ করলে লবণাক্ততায় ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে না।

শুধু বোয়ালখালী নয়, কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী উপজেলা পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী উপজেলায় রোপা বোরো চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছরও বোরো ধানের বড় ক্ষতি হয়েছে খরা ও লবণক্ততার কারণে।

জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামে ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। গত বছর বোরো মৌসুমে পটিয়া উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলার পাঁচরিয়া, হাবিলাসদ্বীপ, জিরিসহ কয়েকটি এলাকায় রোপা ধানের ক্ষতি হয়েছে। কর্ণফুলী নদী, বোয়ালখালী খাল ও শিকলবাহা খালে ছড়িয়ে পড়েছিল লবণাক্ত পানি। এবারও মার্চ মাস থেকে এসব খালে লবণাক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ে।

পটিয়া উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিজয় দাশ জানান, ‘গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার লবণাক্ততার ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে আনার চেষ্টা ছিল। এবার বৃষ্টির পানি ধরে রেখে চাষাবাদ করা হয়েছে। লবণাক্ত পানি অনেকটা কম ব্যবহার করেছেন চাষিরা। তাই বড় ক্ষতি হয়নি।’

বাঁশখালীর ছনুয়া, শেখেরখীল, শীলকূপ, খানখানাবাদ, সাধনপুর, সরল, গন্ডামারা এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি (লবণাক্ত পানি) ধানী জমিতে ঢুকে চাষাবাদের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

কৃষি অফিস জানায়, উপজেলার ১১ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমির চাষাবাদ হয়। সাগর উপকূল এলাকা পাহাড়ি ছড়ার পানি, গভীর-অগভীর নলকূপের পানি দিয়ে চাষাবাদ করা হয়। খানখনাবাদ ইউনিয়নের চৌধুরীঘাট এলাকার কৃষক ফরিদ আহমদ বলেন, সাঙ্গু নদী বা সাগরের শাখা খালের পানি, জল কদর খালের পানি দিয়ে চাষাবাদ হয় না। এসব খালের পানি হচ্ছে লবণাক্ত।

বাঁশখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সালেক বলেন, ‘সাঙ্গু ও সাগরের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি থাকায় চলতি মৌসুমে নলকূপ ও ছড়ার পানি ব্যবহার করে চাষাবাদ করা হচ্ছে।

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা:

লবণাক্ততা ছাড়াও প্রচন্ড তাপমাত্রায় ধানের পরাগায়নে বাধাগ্রস্ত হয়ে ধান চিটা হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশে আবিষ্কৃত ধানের জাত ৩৫ ডিগ্রির কম তাপমাত্রায় আবাদযোগ্য। কিন্তু চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রির কাছাকাছি পৌঁছেছিল। এতে ধানের পরাগায়ন বাধা ও অতিরিক্ত গরমে হিট স্ট্রোকে ধান চিটা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বোয়ালখালী সংবাদদাতা পূজন সেন ও বাঁশখালীর অনুপম কুমার অভি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d