নতুনের জয়গানে সিংহাসনে ফেরার অভিযানে ব্রাজিল
সময়, স্রোত সবই যেন প্রতিকূলে! ব্রাজিলের জন্য বিষয়টি এখন সত্যিই এরকম। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বিবর্ণ, সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে ভাটার টান কাটিয়ে চলছে জোয়ারে ফেরার প্রাণান্ত চেষ্টা। আক্রমণভাগের প্রাণভোমরা নেইমারকে চোটের থাবায় হারানোর হতাশা সঙ্গী। তবু স্বপ্ন দেখছে ব্রাজিল। কোপা আমেরিকা দিয়েই কি তবে মলিনতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে তাদের নবযাত্রার শুরু?
যুক্তরাষ্ট্রে নোঙর ফেলা ব্রাজিল দলের কান্ডারি দরিভাল জুনিয়র। ভদ্রলোকের ‘নেশাই’ যেন ভাঙাচোরা নৌকা নিয়ে বিরুদ্ধ স্রোত পাড়ি দেওয়া। বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকাল ৭টায় ব্রাজিল যখন কোস্টা রিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে কোপা আমেরিকা মিশন শুরু করবে, তখন অনেকেরেই চোখ থাকবে এই দরিভালের দিকে।
সামর্থ্যের প্রমাণ অবশ্য এরই মধ্যে দিয়েছেন দরিভাল। দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে ফ্লামেঙ্গোকে কোপা লিবের্তাদোরেস ও কোপা দো ব্রাজিল জিতিয়েছিলেন। কিন্তু চুক্তি নবায়নের নামগন্ধ নেই! ছয় মাস পর তাই পথ মাপলেন, ধরলেন সাও পাওলোর হাল এবং যথারীতি জেতালেন ব্রাজিলিয়ান কাপ।
দরিভালের ব্রাজিলের দায়িত্বে আসাও বেশ নাটকীয়। দেশটির ফুটবল ফেডারেশন (সিবিএফ) পিছু লেগে ছিল কার্লো আনচেলত্তির। ব্রাজিলিয়ানদের কথায় যেন একরকম ‘নিশ্চিত’ই ছিল এই ইতালিয়ান কোচের নিয়োগ। কিন্তু হবে, হচ্ছে করেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। সিবিএফের আশায় গুঁড়ে বালি ঢেলে, আনচেলত্তি চুক্তি নবায়ন করে থেকে যান রেয়ালে। এরপরই দৃশ্যপটে দরিভালের আগমন এবং যথারীতি রাজ্যের ‘বোঝা’ কাঁধে নিয়ে! ব্রাজিল যে তখন ছুটছিল উল্টোরথে।
সেই ২০০২ সালে রেকর্ড পঞ্চম বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে ‘হেক্সা’র স্বপ্ন দেখেই চলেছে ব্রাজিল। আসর আসে, আসর যায়, ফুরায় না কেবল আপেক্ষা। কোপাকাবানার সৈকতে হয় না বিশ্বজয়ের উৎসব। ২০২২ বিশ্বকাপেও একই স্বপ্ন নিয়ে কাতারে নোঙর ফেলেছিল তারা, কিন্তু কোয়ার্টার-ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরে হতাশার চোরাস্রোতে ভেসে যায় স্বপ্ন।
চলতি বিশ্বকাপ বাছাইয়েও ছয় ম্যাচে ব্রাজিলের জয় মাত্র ২টি। ওই দুই জয়ের পরেরটি ড্র এবং সবশেষ তিনটি ম্যাচে হার। প্রথমবারের মতো এবারের বাছাইয়ে টানা তিন ম্যাচ হারের তেতো স্বাদ পেয়েছে তারা; উরুগুয়ের বিপক্ষে ২২ বছরের মধ্যে প্রথম হারে থেমেছে ঘরের মাঠে বাছাইয়ে ৫৮ ম্যাচের অজেয়যাত্রা। ছয় রাউন্ড শেষে ৭ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলে আছে ষষ্ঠ স্থানে; বাছাইয়ে এটাই ব্রাজিলের সবচেয়ে বাজে পথচলা। অভাবনীয়, অবিশ্বাস্যও!
এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে লাতিন ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ফিরে পাওয়ার মিশনে নেইমারের না থাকা। ব্রাজিলের আক্রমণভাগের জোয়াল বলতে গেলে বেশ কয়েক বছর টেনে চলছিলেন তিনিই। কিন্তু গত অক্টোবরে বাম হাঁটুতে পান চোট, সেই চোটেই শেষ এবারের আসরে তার খেলা।
গত জানুয়ারিতে ব্রাজিলের দায়িত্ব পাওয়ার পর দরিভালও খুঁজতে থাকলেন নেইমারের শূন্যতা পূরণের পথ। পেয়েও গেলেন। গত মৌসুমে রেয়ালের হয়ে দারুণ সময় কাটানো ভিনিসিউস জুনিয়রের কাঁধে তুলে দিলের আক্রমণভাগের গুরুভার। বাকি তরুণদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়ার, উজ্জীবিত করার কাজটিও করতে থাকলেন কায়মনে।
স্রেফ দুই মাসের প্রস্তুতি নিয়ে দরিভাল গেলেন ওয়েম্বলিতে ‘পরীক্ষা’ দিতে। দারুণভাবে পাসও করে গেলেন তিনি। এন্দ্রিকের একমাত্র গোলে ইংল্যান্ডকে হারাল ব্রাজিল। পরের তিন ম্যাচেও ৬২ বছর বয়সী এই কোচের হাত ধরে হারেনি সেলেসাওরা। স্পেনের বিপক্ষে ৩-৩ ড্রয়ের পর কলম্বিয়ার বিপক্ষে ৩-২ গোলের জয় এবং সবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১-১ ড্র। কোপা মিশন শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ড্র তৃপ্তির না হোক, হার এড়ানোর স্বস্তি অন্তত আছেই।
সবচেয়ে বড় কথা, ওয়েম্বলি ও সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ের আঙিনায় একটা ‘রত্ন’ পেয়ে গেলেন দরিভাল, যেটা তিনি খুঁজছিলেন এতদিন। ছেলেটির নাম এন্দ্রিক। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ওয়েম্বলিতে জালের দেখা পাওয়ার পর স্পেনের বিপক্ষেও দলকে এনে দিলেন সমতাসূচক গোল।
রেয়ালে নাম লেখানো এই তরুণ সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে সেদিন পেয়েছিলেন ক্লাব সমর্থকদের বাহবা। এরই মধ্যে তার ভেতর কিংবদন্তি পেলের ছায়া দেখতে শুরু করেছেন অনেকে। এন্দ্রিক অবশ্য হাওয়ায় ভাসছেন না তাতে, বিনয়ের সাথে তুলনাকে একপাশে রেখে ছুটতে চাইছেন নিজের মতো করে। এবার কোপা আমেরিকায় সেলেসাও সমর্থকদের বাহবা পাওয়ার পালা তার।
যদিও এবার ভিনিসিউস, এন্দ্রিক কিংবা ব্রাজিলকে নিয়ে মাতামাতি নেই তেমন একটা। আলোচনার ভরকেন্দ্রে এই প্রতিযোগিতার শিরোপাধারী আর্জেন্টিনা; বিশ্বচ্যাম্পিয়নও তারা। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের দিক থেকে সবটুকু আলো কেড়ে রেখেছেন লিওনেল মেসি। ইউরোপ মাতিয়ে মেজর সকার লিগের দল ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেওয়া এই আর্জেন্টাইন মহাতারকা ৩৭ বছর বয়সে এসেও সবার মধ্যমণি।
ব্রাজিলের অর্জনের শোকেসে দ্যুতি ছড়াচ্ছে কোপা আমেরিকার ৯টি শিরোপা। সবশেষটি অবশ্য ২০১৯ সালে। এরপর থেকে বন্ধুর পথ পাড়িয়ে দেওয়া ব্রাজিলকে নিয়ে হয়তো এবার অনেকেরই বড় প্রত্যাশা নেই।
কিন্তু পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে থাকা, আড়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা, প্রত্যাশাহীন দলকে সাফল্যের বন্দরে পৌঁছে দেওয়া-এসব অভিজ্ঞতার সঙ্গে দরিভাল পরিচিত ক্লাব পর্যায় থেকেই। আশাহীনভাবে ভাসতে থাকা ব্রাজিলকে দরিভাল সাফল্যের বন্দরে পৌঁছে দিতে পারবেন কিনা, তার ইঙ্গিত মিলতে পারে কোস্টা রিকা ম্যাচ থেকেই।
কেননা, দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম তিন সপ্তাহের ‘লম্বা সময়’ খেলোয়াড়দের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন দরিভাল। ছক বুঝিয়ে দিয়েছেন শিষ্যদের। এখন অপেক্ষা হিসেব মিলিয়ে নেওয়ার।
এন্দ্রিক তারুণ্যের দ্যুতি ছড়ালে, নেইমারের ছায়া থেকে ভিনিসিউস জুনিয়র বেরিয়ে আসতে পারলে দুলতে থাকা ব্রাজিলের নৌকা পোতাশ্রয়ে পৌঁছাতেই পারে। শক্ত হাতে তো হাল ধরেই আছেন দরিভাল। তাছাড়া দলটার নামও তো ব্রাজিল।