চট্টগ্রামস্বাস্থ্য

নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে হুমকি হতে পারে ফ্যাটি লিভার

পৃথিবী জুড়েই নীরব মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে ফ্যাটি লিভার। বাংলাদেশেও এই রোগে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ এ রোগে ভুগছেন। এ রোগের প্রধান কারণ-মানুষের জীবনযাপনের বিরূপ প্রভাব এবং খাদ্যাভ্যাস ও কায়িক পরিশ্রম না করা। উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে থাকা ফ্যাটি লিভার এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সামনে হুমকি হতে পারে। তবে আশার কথা-খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন করতে পারলেই এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। তাই রোগ প্রতিরোধে প্রান্তিক পর্যায়ে পর্যন্ত সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে পূর্বকোণ সেন্টারের ইউসুফ চৌধুরী কনফারেন্স হলে বিশ্ব ফ্যাটি লিভার দিবস-২০২৪ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আলোচনা সভা আয়োজন করে ‘লিভার কেয়ার সোসাইটি’। লিভার কেয়ার সোসাইটি’র সভাপতি ও চমেক হাসপাতালের লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল মাহমুদের সভাপতিত্বে এবং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তারেক শামস’র সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন চমেক হাসপাতালের লিভার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আলোক কুমার রাহা, শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সনৎ কুমার বড়–য়া, ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সত্যজিৎ মল্লিক, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. ঝুলন বড়ুয়া, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম।

ডা. আলোক কুমার রাহা বলেন, চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম না করা ব্যক্তিদের এই রোগ বেশি হয়। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা না হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য হুমকি হতে পারে। তবে আতংকগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। কায়িক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো চললে ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধ করে সুস্থ থাকা যায়।

ডা. সনৎ কুমার বড়ুয়া বলেন, বড়দের পাশাপাশি ফ্যাটি লিভার এখন শিশুদেরও হচ্ছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশুদের এই রোগের প্রাদুর্ভাব ০.৭৫ শতাংশ। ১৮ বছর নিচের শিশুদের ৭ শতাংশ। স্থূলতা যাদের তাদের ৩৪ শতাংশ। এখনকার শিশুরা ওভার ওয়েট হয়ে যাচ্ছে, স্থূলতা তাদের বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে তারা ফ্যাটি লিভারেও আক্রান্ত হচ্ছে। তবে এটি প্রতিরোধ করা যায়। মায়েদের শিশুকে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। তাকে রেডিমেট খাবার দেয়া যাবে না। শিশুদের খেলাধুলা করতে দিতে হবে। সারাদিন বাসায় বন্দী রাখা যাবে না।

ডা. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, আমাদের দেশে শতকরা ৩৪ ভাগ মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত কোন ওষুধও এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। সুতরাং এ থেকে মুক্তি পেতে লিভারের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। ওষুধ নয়, প্রতিরোধেই একমাত্র উপায়। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এবং জীবনধারার পরিবর্তন- এ দুইটি করতে পারলেই ফ্যাটি লিভার থেকে বাঁচা সম্ভব হবে। এছাড়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, স্কুলে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। রাস্তায় চলাচলের ফুটপাতগুলো ব্যবহারের উপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দৃষ্টি কামনা করছি।

ডা. তারেক শামস বলেন, বর্তমানে প্রায় ১১ কোটি মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। যা ২০৩০ সালে ৩৫ কোটি ছাড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের দেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ এ রোগে ভুগছেন। তাই প্রতিরোধই একমাত্র প্রতিকার।

ডা. সত্যজিৎ মল্লিক বলেন, ডায়াবেটিস এবং ফ্যাটি লিভার দুটোই প্রায় একই কারণে হয়ে থাকে। ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত প্রায় ৭৫ ভাগ রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ফ্যাটি লিভার পাওয়া গেছে। এর কারণ হচ্ছে ইনসুলিন রেজিস্ট্রেন্স। ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার কারণে যাদের ফ্যাটি লিভার হচ্ছে, তারা সবচেয়ে বেশি জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে। সুতরাং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ডা. ঝুলন বড়ুয়া বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বে ফ্যাটি লিভার রোগীর সংখ্যা ৩০ ভাগ। অর্থাৎ প্রতি একশ জন মানুষের ৩০ জন ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। এরমধ্যে ২ দশমিক চারভাগ রোগী লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। ফ্যাটি লিভার থেকে লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ প্রতি হাজারে পাঁচজন। ন্যাস থেকে প্রতি হাজারে ২৮ জনের লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ফ্যাটি লিভার থেকে লিভার সিরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ২৪ জনের। সিরোসিস থেকে রক্তবমি, অজ্ঞান হওয়া, পেটে পানি আসা ইত্যাদি জটিলতা হয়।

মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগের মতো খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ততা দেখা যায় না। বরং মোবাইল ফোনে সারাক্ষণ বাসায় বন্দী হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে সুষম খাদ্যভ্যাসের চিন্তা নেই বললেই চলে। যত অপুষ্টিকর খাবার আছে, তা গ্রহণ করছে তারা। আর এ কারণে শিক্ষার্থীরা অল্প বয়সেই স্থূলতা বা ওভার ওয়েট হয়ে যাচ্ছে। রোগমুক্ত থাকতে তাদের শিক্ষকরা স্কুলে এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের ফ্যাটি লিভারে ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d