নির্বাচনী মাঠে আঞ্চলিক দল, নানা শঙ্কা পাহাড়ে
নানা ইস্যুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো। এরই মধ্যে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-প্রসীত এবং ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক সমর্থিত প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
অন্যদিকে মহালছড়িতে প্রার্থী দেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-সংস্কার। অন্য উপজেলাগুলোতেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার আভাস দিয়েছে দলগুলো। খাগড়াছড়িতে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতির কার্যক্রম না থাকায় কখনো তারা প্রার্থী দেয়নি।
গত জাতীয় নির্বাচনের মতো এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না বিএনপি। তারা ভোটে না আসায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বাড়তি সুবিধা পাবেন মনে করা হলেও পাহাড়ে আছে নানান হিসেব-নিকেশ। এখানে নির্বাচনে আঞ্চলিক দলগুলো অংশ নেওয়ায় লড়াইয়ের আভাস যেমন মিলছে, তেমনি আছে নানান উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব থেকে নির্বাচনী মাঠে সংঘাত হওয়ার বিষয়টিও উড়িয়ে দিচ্ছেন স্থানীয়রা। বিশেষত পানছড়িতে আঞ্চলিক রাজনীতির অস্থিরতার মধ্যে বিবদমান দলগুলোর প্রার্থী থাকায় দুশ্চিন্তার ডালপালা মিলছে বেশি।
প্রথম ধাপে আগামী ৮ মে খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি, মানিকছড়ি, রামগড় ও মাটিরাঙ্গা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে দীঘিনালা, পানছড়ি ও সদর উপজেলার নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
দীঘিনালা, পানছড়ি ও লক্ষীছড়িতে ইউপিডিএফ-প্রসীত গ্রুপের আধিপত্য রয়েছে। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রসীত গ্রুপের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের চার শীর্ষ নেতা খুন হন। ওই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে অনেকটা জিম্মি অবস্থায় পানছড়িবাসী। সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে বাজার বয়কট করছে দলটি। এতে কেনাকাটা অনেকটা বন্ধ বলা চলে। এমনকি সন্ধ্যার পর পানছড়িতে যানবাহন চলাচলেও ইউপিডিএফ-প্রসীত গ্রুপের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই ইস্যুতে বেশ কয়েকটি সহিংস ঘটনাও ঘটেছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে লক্ষীছড়ি, পানছড়ি ও দীঘিনালায় ১৯টি কেন্দ্রে ভোটশূন্য রেখে এলাকায় নিজেদের আধিপত্যের জানান দিয়েছে দলটি। এবার ইউপিডিএফের এই গ্রুপ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় কেন্দ্রগুলোতে উল্টোচিত্র দেখা যেতে পারে। সংসদ নির্বাচনে এলাকায় ভোট দিতে নিষেধ করলেও উপজেলা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য প্রভাব বিস্তার করবে তারা। তবে পানছড়িতে ইউপিডিএফের অপর অংশের প্রার্থী থাকায় উভয়ের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে।
লক্ষীছড়িতে ইউপিডিএফ সমর্থিত সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা পুনরায় প্রার্থী হয়েছেন। মহালছড়িতে জনসংহতি সমিতি সংস্কার প্রার্থী দেবে। দীঘিনালায় চেয়ারম্যান পদে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা আর হচ্ছে না। হলফনামায় মামলার তথ্য গোপন করায় ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী ধর্মজ্যোতি চাকমার প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মো. কাশেম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে। সদর উপজেলায়ও প্রার্থী-সমর্থন থাকছে দলগুলোর।
ইউডিএফ-প্রসীত গ্রুপের মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, প্রত্যাশিত অবস্থা না থাকলেও জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। যেখানে আমাদের কার্যক্রম আছে সেখানে আমাদের প্রার্থী থাকবে। অন্য জায়গাগুলোতে দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা থাকবে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আমাদের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন। যদিও রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টিসহ নানা অপকৌশল নিয়ে দমিয়ে রাখতে চাইবে।
অন্য আঞ্চলিক দলগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, বিভিন্ন উপজেলায় তারা প্রার্থী দাঁড় করিয়ে অপহরণ, খুনোখুনির মত অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।
নির্বাচনকালীন পানছড়িতে বাজার বয়কট কর্মসূচি স্থগিত থাকবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যে কারণে বাজার বয়কট করছি সেই দাবি তো পরিপূর্ণ হয়নি। আমাদের লোকদের যারা হত্যা করেছে তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আমাদের ধারাবাহিক আন্দোলন করতে হচ্ছে। খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বয়কট নিয়ে আমরা ভাববো।
অপর ইউপিএিফ-গণতান্ত্রিকের কেন্দ্রীয় সভাপতি জলেয়া চাকমা বলেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়া আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। আমরা সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করি। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নির্বাচনে অংশ নেব। নির্বাচনে পানছড়িতে আমাদের প্রার্থী থাকবে। অন্য উপজেলাগুলোতে অবস্থা বুঝে আমাদের সমর্থন থাকবে।
প্রতিপক্ষ প্রসীত গ্রুপকে ইঙ্গিত করে এই নেতা বলেন, আমরা গণতান্ত্রিক দল। মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হতে চাই। অন্যরা তো সাধারণ মানুষকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। তারা সব সময় একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। নির্বাচনে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইলে তা মোকাবিলায় আমাদেরও অবস্থান থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর ও বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে আমাদের প্রার্থী থাকবে। অন্য উপজেলাগুলোতে সরাসরি প্রার্থী না থাকলেও আমাদের সমর্থন এবং ভূমিকা থাকবে। বাকি উপজেলাগুলোতেও আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে।
সারাদেশের সঙ্গে পাহাড়ের রাজনীতি ভিন্ন থাকায় স্থানীয়ভাবে আঞ্চলিক রাজনীতির কাছে অনেকটা কোণঠাসা জাতীয় দলগুলো। আঞ্চলিক দলগুলোর আধিপত্যের জায়গাগুলোতে সুবিধা করতে পারেন না জাতীয় দলের প্রার্থীরা।
খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী বলেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়া সবার অধিকার। তাদের অংশগ্রহণকে স্বাগত জানাই। তবে আশা করবো কোনো রকম সংঘাত সহিংসতা ছাড়া সবার সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) খাগড়াছড়ি শাখার সভাপতি নাসির উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনগুলোতে তৃণমূলের প্রার্থী থাকায় ভোটাদের উপস্থিতিও স্বতস্ফূর্ত হয়। তবে বিগত অনেক নির্বাচনে আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাতপূর্ণ কার্যক্রম মনে পড়লে আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। আমরা আশা করবো ভোটারদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সব পক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করবে।