পরিবর্তনের প্রত্যাশায় আজ ব্যালটের পরীক্ষায় যুক্তরাজ্য
টোরি শাসনের ১৪ বছরে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী দেখেছে যুক্তরাজ্য; ব্রেক্সিট প্রশ্নে বিভক্তি পাল্টে দিয়েছে ব্রিটেনের চলার পথ। ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন আর অর্থনীতির চাপে ডাউনিং স্ট্রিট মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত হলেও কনজারভেটিভরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল, কিন্তু এবারের বাস্তবতা ভিন্ন। সব জরিপের ফলাফলে ক্ষমতায় ফেরার সুবাস পাচ্ছে লেবার পার্টি।
ভঙ্গুর অর্থনীতি, জীবনযাপনে ব্যয়ের বোঝা এবং অভিবাসন ও গাজা যুদ্ধসহ বৈশ্বিক বাস্তবতায় এক কঠিন সময়ে সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিতে যাচ্ছে বিশ্বের ষষ্ঠ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাজ্য।
প্রায় দেড় মাস ধরে ৯৫টি দল ও স্বতন্ত্র মিলে রেকর্ড ৪ হাজার ৫১৫ প্রার্থীর ভোট চাওয়ার পালা বুধবার শেষ হয়েছে। সংকট উত্তরণে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ডালি নিয়ে তারা হাজির হয়েছেন ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে।
এবার রায় দেবার পালা। যুক্তরাজ্যের চার রাজ্য ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দান আয়ারল্যান্ড মিলে ৬৫০টি সংসদীয় আসনের সাড়ে চার কোটির বেশি ভোটার বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সকাল থেকে ব্যালট পেপারে ক্রস চিহ্ন দিয়ে জানাবেন, কারা হবেন পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধি। তাতেই নির্ধারিত হবে– কোন দলের হতে যাবে যুক্তরাজ্যের শাসনভার।
কনজারভেটিভ পার্টির (টোরি) নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এবং প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমারসহ অন্যান্য দলের নেতারা ভোটারদের কেন্দ্রে এসে তাদের সাংবিধানিক ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান রেখে তাদের প্রচার-অভিযান শেষ করেছেন।
গতবারের চার এমপি রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক ও আফসানা বেগমসহ এবার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রেকর্ড ৩৪ জন প্রার্থী নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন, যাদের প্রচার ঘিরে যুক্তরাজ্যে অভিবাসী ও প্রবাসী মিলে ১০ লাখের বেশি ব্রিটিশ-বাংলাদেশির মধ্যে দেখা গেছে উৎসবের আমেজ।
বিবিসি লিখেছে, বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা থেকে একটানা রাত ১০টা পর্যন্ত ভোট দিতে পারবেন যুক্তরাজ্যের আঠারোর্ধ্ব বয়সি নাগরিকরা। রাত ১০টাতেও লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তির ভোট নেওয়া হবে, তাতে যত সময় লাগে লাগুক। ভোটগ্রহণের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন।
সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভোটে জিতে সরকার গঠনের জন্য যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের মধ্যে যে কোনো দল বা জোটের প্রয়োজন ৩২৬টিতে জয়। ২০১৯ সালে ৩৬৫ আসনে জিতে সরকার গড়ে টোরি পার্টি, যেখানে লেবার পায় ২০২টি।
তবে কয়েকটি উপনির্বাচনে আসন হারানোয় ৩০ মে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া পর্যন্ত টোরিদের দখলে ছিল ৩৪৪টি, আর লেবারের আসন বেড়ে হয় ২০৫টি।
সর্বশেষ সব জরিপের ফলাফলে এবারের নির্বাচনে ‘ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ নিয়ে জয়ের বন্দরে নোঙরের অপেক্ষায় থাকা কিয়ার স্টারমারের দল লেবার পার্টির প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার খবর এসেছে। স্টারমার তার শেষ আহ্বানে ‘পরিবর্তনের পক্ষে ভোট’ চেয়েছেন।
অন্যদিকে ভোটগ্রহণের আগের দিন বুধবার নিজ দলেরই মন্ত্রীর ‘অনিবার্য পরাজয়’ স্বীকার করে নেওয়ার ঘটনায় ‘পরাজয়ের আগেই হেরে যাওয়া’ কনজারভেটিভ পার্টি শেষ মুহূর্তে যেন মুখরক্ষার দিকে মনোযোগ দিয়েছে। টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটির বর্তমান প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক অবশ্য বলেছেন, শেষ ভোটটির দিকেও তাকিয়ে থাকবেন তিনি।
বিংশ ও একাবিংশ শতাব্দীতে ঘুরে ফিরে যুক্তরাজ্যের শাসন-মসনদে থাকা লেবার ও টোরি পার্টিকে এবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ভোটের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছেন আরও কয়েকটি দলের জনপ্রিয় প্রার্থী এবং রেকর্ড ৪৫৯ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিরাচরিত প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর বাইরে এবার ভোটের মাঠ গরম করেছে, এমন দলগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে জাতীয় পর্যায়ে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টি, ইউকে রিফর্ম, গ্রিন পার্টি এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে স্কটল্যান্ডভিত্তিক স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি), নর্দান আয়ারল্যান্ড ভিত্তিক ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টি (ডিইউপি) ওয়েলসভিত্তিক প্লেইড সিমরু।
গত ২২ মে হঠাৎ করে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে চমক সৃষ্টি করেন যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং সেদেশের হিসাবে শতাব্দীর ‘সর্বকনিষ্ঠ’ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাংবিধানিক রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দেশ যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রের প্রধান রাজা তৃতীয় চার্লস, যার কাজ পুরোটাই আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ। সে অনুযায়ী ২২ মে-তেই নির্বাচনের তারিখ অনুমোদন করে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার প্রধানমন্ত্রী অনুরোধ রাখেন তিনি। রাজার আদেশ অনুযায়ী, ৩০ মে পার্লামেন্ট ভেঙে যায়।
যুক্তরাজ্যের সরকার ব্যবস্থা পাঁচ বছর মেয়াদি। সংবিধান অনুযায়ী, মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী, ২০১৯ সালে নির্বাচনের পর পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে হওয়ার কথা ছিল।
অনেকের ধারণা ছিল, ঋষি সুনাক হয়ত নির্বাচনের সময় কিছুটা এগিয়ে অক্টোবরে দিতে পারেন। তবে সবার ধারণা উল্টে দিয়ে দলীয় জনপ্রিয়তার তলানিতে থাকার মধ্যেই ৪ জুলাই সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন তিনি।
সে অনুযায়ী যুক্তরা্যেজুড়ে ভোটগ্রহণ হচ্ছে বৃহস্পতিবার, স্থানীয় সময় মধ্যরাতেই কয়েকটি আসনের ফল হয়ত বেরিয়ে যাবে। শুক্রবার ভোরের দিকে, অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় শুক্রবার দুপুরের মধ্যে ফলাফল স্পষ্ট হয়ে যাবে। তার আগে কেন্দ্রফেরত জরিপেও পাওয়া যাবে জয়-পরাজয়ের সম্ভাব্য চিত্র।
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঘোষিত বেসরকারি ফলাফলে জয় নিশ্চিত হয়েছিল কনজারভেটিভ পার্টির।
যুক্তরাজ্যের ভোট ব্যবস্থা : যুক্তরাজ্যজুড়ে ৬৫০টি নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে হাউজ অব কমন্সের সদস্যপ্রার্থীদের নির্বাচিত করে থাকেন। এ পদ্ধতি বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় নির্বাচনেরই মত। যে আসনে যে প্রার্থী অন্য সবার চেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তিনিই জয়ী হিসেবে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হবেন। প্রার্থী কত শতাংশ বা কার তুলনায় কী অনুপাতে ভোট পেলেন সেসব বিবেচ্য নয়; গৃহীত ভোটে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকাটাই জয়ের একমাত্র নির্ধারক।
হাউজ অব কমন্সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনে যে কোনো দলের ৫০ শতাংশের চেয়ে বেশি আসন পেতে হয়, সে যদি হয় একটি আসনও বেশি, তা নিশ্চিত করে তবেই সরকার গঠন করতে হয়। কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে অন্য দলের সমর্থন নিয়ে জোট সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতার এ নিয়ম একই।
ভোটারদের তিনভাবে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে যুক্তরাজ্যের নির্বাচন কমিশন। এক. সশরীরে কেন্দ্রে গিয়ে। দুই. ডাকযোগে। তিন. মনোনীতি ব্যক্তির মাধ্যমে অর্থাৎ যাদের নিজ কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার আর কোনো উপায় নেই, তাদের জন্য এই ব্যবস্থা। সব ক্ষেত্রেই ভোট দিতে ভোটাদের ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র প্রদর্শন আবশ্যক।
বিবিসি বলছে, ডাকযোগে ভোট দিতে চাওয়া নাগরিকদের কাছে সময় মত ব্যালট পৌঁছাতে না পরায় অনেকের ভোট দেওয়ার ফিরতি ডাক হয়ত ৪ জুলাই রাত ১০টার আগে কেন্দ্রে আসবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এসএনপির ওয়েস্টমিনস্টার নেতা স্টিফেন ফ্লিন। তবে দেশটির ডাক বিভাগ রয়্যাল মেইল এটি মানতে নারাজ।
যুক্তরাজ্যের সরকারের কাঠামো : যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট- হাউজ অব কমন্স অর্থাৎ নিম্নকক্ষ এবং হাউজ অব লর্ডস অর্থাৎ উচ্চকক্ষ। নিম্নকক্ষের সদস্য ৬৫০ জন, যারা দেশের জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন।
অবশ্য হাউজ অব লর্ডসের সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত নয়। ২০ জুন ২০২৪ পর্যন্ত ৭৮৪ জন লর্ডস বহাল ছিলেন।
সরকারের নির্বাহী শাখা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার মেয়াদ পাঁচ বছর। নিজে শপথ গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী সাধারণত নিজ দলের জ্যেষ্ঠ ও যোগ্য আইনপ্রণেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন এবং তিনি মন্ত্রীদের দায়িত্ব বণ্টন করে দেন।
যুক্তরাজ্যের সর্বশেষ পার্লামেন্ট
গত ৩০ মে সংসদ বিলু্প্ত হওয়ার দিনে ৬৫০ আসনের হাউজ অব কমন্সে ছিল ১৩টি দল এবং ১৭ জন স্বতন্ত্র সদস্য।
* কনজারভেটিভ: ৩৪৪ আসন
* লেবার: ২০৫ আসন
* এসএনপি: ৪৩ আসন
* লিবারেল ডেমোক্র্যাটস: ১৫ আসন
* ডিইউপি: ৭ আসন
* এসডিএলপি: ২ আসন
* অ্যালায়েন্স: ১ আসন
* গ্রিন: ১ আসন
* আলবা: ২ আসন
* প্লেইড সিমরু: ৩ আসন
* সিন ফেইন: ৭ আসন
* রিফর্ম ইইকে (বিলুপ্ত ব্রেক্সিট): ১ আসন
* ওয়ার্কার্স পার্টি: ১ আসন
* স্বতন্ত্র: ১৭ আসন
* স্পিকার: ১ আসন
কী ঘটেছিল আগের নির্বাচনগুলোতে?
কনজারভেটিভ পার্টি গত ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে; এই সময়ে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন ডেভিড ক্যামেরন। ব্রেক্সিট গণভোটে হেরে পরাজয় স্বীকার করে পদত্যাগ করলে একই বছর তার স্থলাভিষিক্ত হন টেরিজা মে। তাকে হটিয়ে ক্ষমতায় বসেন বরিস জনসন।
২০১৯ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভরা মোট গৃহীত ভোটের ৪৩ শতাংশ এবং ৩৬৫টি আসন পায়। তখন দলের নেতা ছিলেন কট্টর জাতীয়বাদী চিন্তাধারার বরিস জনসন।
তবে শেষ পর্যন্ত সব আসন তারা ধরে রাখতে পারেনি, উপনির্বাচনে কিছু আসন খুইয়ে ৩০ মে ২০২৪ পর্যন্ত তাদের আসন ছিল ৩৪৪টি।
কোভিড মহামারীর লকডাউনের সময় আইন ভেঙে মদের পার্টি দেওয়ার কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হন লিজ ট্রাস।
বামপন্থি চিন্তাধারার জেরেমি করবিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি ২০১৯ সালে ৩২ শতাংশ ভোট এবং ২০২টি আসন পায়। অবশ্য উপনির্বাচনে জিতে তাদের আসন শেষ পর্যন্ত ২০৫টিতে দাঁড়ায়।
সর্বশেষ লেবার সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন গর্ডন ব্রাউন, যিনি ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার আগেও ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লেবার নেতা টনি ব্লেয়ার।
প্রধান দলগুলোর চরিত্র
* ‘টোরি’ নামে পরিচিত যুক্তরাজ্যের ‘ওল্ড গ্রান্ড পার্টি’ হল কনজারভেটিভ পার্টি। ডানপন্থি দলটিকে কখনও কখনও মধ্য-ডানপন্থি ভূমিকা নিতে দেখা যায়। বর্তমানে ঋষি সুনাক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি ২০২২ সালের অক্টোবরে লিজ ট্রাসের কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
* লেবার পার্টি একটি মধ্য-বামপন্থি দল, যার বর্তমান নেতা কিয়ার স্টারমার।
* লিবারেল ডেমোক্র্যাটস দলটি মধ্য থেকে মধ্য-বামপন্থি দল, যার বর্তমান নেতা এড ডেভি। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় ছিল দলটি।
* কার্লা ডেনিয়ার এবং আড্রিয়ান রামসের নেতৃত্বে রয়েছে গ্রিন পার্টি। বামপন্থি দলটির প্রধান রাজনীতি পরিবেশ রাজনীতি এবং ধরিত্রী বাঁচাতে নীতি প্রণয়ন ও তার সুরক্ষা দেওয়া।
* রিফর্ম ইউকে পার্টি উগ্র জাতীয়বাদী নেতা নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি দল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আন্দোলন-ব্রেক্সিট এর পক্ষে জনমত গঠন করার সময় ‘ব্রেক্সিট পার্টি’ নামে দল গঠন করেছিলেনি; ব্রেক্সিট সফল হওয়ার পর নাম বদলে রাখেন ‘রিফর্ম ইউকে’।
* স্কটল্যান্ড রাজ্যের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি একটি মধ্য-বামপন্থি দল, যার বর্তমান নেতা জন সুইনি।
* মধ্য বাম থেকে বামপন্থি ভূমিকা রাখতে দেখা যায় যুক্তরাজ্যের ওয়েলস রাজ্যভিত্তিক দল প্লেইড সিমরু, এখন এর নেতা রুন অ্যাপ ইয়োরওয়ের্থ।
* যুক্তরাজ্যের আরেক রাজ্য নর্দান আয়ারল্যান্ডভিত্তিক দল ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টি। দলটি মধ্যডানপন্থি, যারা নেতৃত্বে আছেন গ্যাভিন রবিনসন।
রেকর্ড বাংলাদেশি প্রার্থী : নির্বাচনে বিভিন্ন দলের মনোনয়নে প্রার্থী হয়েছেন সব মিলিয়ে অন্তত ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক।
লেবার পার্টি থেকে আছেন ৮ জন। এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং আবার মনোনয়ন পেয়েছেন এমন চারজন হচ্ছেন- রুশনারা আলি, রুপা হক, টিউলিপ সিদ্দিক ও আফসানা বেগম। অপর চার প্রার্থীর মধ্যে আছেন- রুমী চৌধুরী, রুফিয়া আশরাফ, নুরুল হক এবং নাজমুল হোসাইন।
কনজারভেটিভ পার্টি থেকে আছেন দুজন- আতিক রহমান ও সৈয়দ সাইদুজ্জামান। রিফর্ম ইউকে থেকে একজন, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস থেকে একজন, এসএনপি থেকে একজন, গ্রিন পার্টি থেকে তিনজন, সোশ্যালিস্ট পার্টি থেকে একজন, ওয়ার্কার্স পার্টি অব ব্রিটেন থেকে ৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ১১ জন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্যে ইতিহাস সৃষ্টিকারী রুশনারা আলী এবার সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে রয়েছেন। চার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীসহ ১০ প্রার্থীকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে রুশনারাকে।
নির্ণায়ক কী : জরিপ সংস্থা ইউগভের এক জরিপে দেখা গেছে, নির্বাচনের আগে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, অভিবাসন, আবাসন সংকট ও পরিবেশ। এসব বিষয়ের সুরাহা চেয়েছেন তারা।
২৪ জুনের জরিপের ফলাফল অনুযায়ী-
# অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি চায়: ৫২% মানুষ
# স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি চায়: ৫০% মানুষ
# অভিবাসন ও আশ্রয় ইস্যুর মীমাংসা চায়: ৪০% মানুষ
# আবাসন সংকটের সমাধান চায়: ২৪% মানুষ
# পরিবেশের ওপর সরকারের গুরুত্ব দেখতে চায়: ২০% মানুষ
কোন দল কোথায় দাঁড়িয়ে : সর্বশেষ মঙ্গলবার জরিপ সংস্থা সার্ভেশন জানিয়ছে, বৃহস্পতিবারের ভোটে কিয়ার স্টারমারের লেবার পার্টি ৬৫০ আসনের মধ্যে ৪৮৪টিতে জয় যেতে যাচ্ছে।
এর আগে ইউগভ ও ইপসোসের করা সব জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, এবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে চলেছে লেবার পার্টি।
১৯৯৭ সালে টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে লেবার পার্টি ৪১৮টি আসনে জয়ী হয়ে তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জয় পেয়েছিল। এবার সেই রকর্ড ভাঙতে পারে, স্টারমারের নেতৃত্বে দলটি পৌনে পাঁচশর মত আসন পেতে পারে বলে জরিপ সংস্থাগুলো আভাস দিচ্ছে।
কনজারভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ার আভাস ছিল বিগত এক বছরজুড়ে। এই সময়ে করা জরিপগুলোতে লেবার পার্টির প্রতি জনসমর্থন ধারাবাহিকভাবে ৪০ শতাংশর ওপরে দেখা গেছে।
অবশ্য জনমত জরিপের ফল ভুলও প্রমাণিত হতে পারে। ঋষি সুনাকেরও আশা, তার সাম্প্রতিক সাফল্য এবং দল নিয়ে তার সিদ্ধান্ত ভোটের পরিস্থিতিকে কনজারভেটিভ পার্টির অনুকূলে নিয়ে আসবে।
বুধবার (৩ জুলাই) প্রচারের শেষ ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সুনাক বলেছেন, শেষ ভোটারের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন, যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা বুঝেশুনে ভোট দেবেন।
লেবারের সঙ্গে ব্যবধান যা-ই হোক, পার্লামেন্টে টোরি পার্টিই বিরোধী দল হচ্ছে, সেটিও জরিপগুলোর পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।
জরিপ অনুযায়ী, নির্বাচনের ফলাফলে এবার তৃতীয় অবস্থানে থাকতে পারে অভিবাসনবিরোধী ‘চরম ডানপন্থি’ দল রিফর্ম ইউকে। আসন পাওয়ার ভিত্তিতে লিব ডেম তৃতীয় অবস্থান হারিয়ে এবার চতুর্থ হতে পারে, তবে তারা প্রায় ১০ শতাংশ ভোট টানতে পারে।
এখন কেন নির্বাচন : আগাম নির্বাচন ঘোষণার আগের কয়েকটি দিন ছিল প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের জন্য তুলনামূলক ভালো। সে সময় যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যুক্তরাজ্যে প্রবৃদ্ধির নতুন পূর্বাভাস দিচ্ছিল এবং মূল্যস্ফীতি অবশেষে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফেরার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। এ বছর এপ্রিল-মে মাসে যুক্তরাজ্য সরকার মূল্যস্ফীতি কমার সুখবর পায়।
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুনাক সেই সুখবর জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কমে ২ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে, যা তার আগের মাসে অর্থাৎ, মার্চে ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ। আর মে মাসে মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়ায় ২ শতাংশে, যেটি ছিল সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্য।
ফলে প্রায় তিন বছরের মধ্যে প্রথম সরকার তাদের মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে সক্ষম হয়। আর সুনাক, যিনি ক্ষমতায় বসেছিলেন মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকা, প্রবৃদ্ধি না থাকা এবং অভিবাসন সংকটের নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে, সেগুলো মোকাবেলাতেও তার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়।
এ পরিস্থিতিতে সবকিছু সঠিক পথে চলছে বলার একটি সুদৃঢ় ভিত্তি পেয়ে ‘ঝোঁপ বুঝে কোপ মারেন’ ঋষি সুনাক। ঘোষণা দেন আগাম নির্বাচনের।
ঋষি সুনাকের ‘রুয়ান্ডা পরিকল্পনা’র কী হবে : যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হওয়ার আগেই কিছু আশ্রয়প্রার্থীকে রুয়ান্ডায় পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঋষি সুনাক। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এই নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
এ নীতি বাস্তবায়িত হলে তা নৌকায় চেপে মানুষের ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে ঢোকা কমবে বলেই যুক্তি সুনাকের। কিন্তু আগাম নির্বাচন ঘোষণার পর সুনাক বলেছিলেন, তিনি পুনর্নির্বাচিত হলে শুরু হবে এ প্রকল্প।
ওদিকে লেবার পার্টি বলছে, তারা ক্ষমতায় গেলে এ পরিকল্পনা বাতিল করা হবে। ফলে সুনাকের রুয়ান্ডা পরিকল্পনার কি হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এরই মধ্যে রুয়ান্ডা পরিকল্পনায় ২৪ কোটি পাউন্ড ব্যয় হয়েছে যুক্তরাজ্যের। নির্বাচনি প্রচারেও এই নীতিকে ঘিরে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন দেখা গেছে।
বাংলাদেশি অভিবাসী : সুনাকের রুয়ান্ডায় অভিবাসী স্থানান্তর পরিকল্পনার সমালোচনা করতে গিয়ে কিয়ার স্টারমার বাংলাদেশিদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে নির্বাচনের আগে হই চই ফেলে দেন।
তাতে করে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় ভোটের লড়াইয়ে লেবারের পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তীব্র অসন্তোষের মুখে সুর নরম করতে বাধ্য হয়েছেন স্টারমার। বিবৃতিতে দিয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশি অভিবাসীদের ‘অবৈধ’ বলেননি তিনি।
অবশ্য দলীয় নেতা স্টারমারের সঙ্গে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানান রুশনারা, টিউলিপ, আফসানা ও রুপারা।
ভোটের ফল ঘোষণার পর কী হবে : ভোট গণনার পর যে দলের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সংসদ সদস্য (এমপি) রয়েছে, সেই দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এবং সরকার গঠন করার জন্য আহ্বান জানাবেন রাজা। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এমপি থাকা দলের নেতাই হবেন পার্লামেন্টে বিরোধী দলনেতা।
যদি কোনো দলই সংসদ সদস্যের সংখ্যার নিরিখে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে সেই দল নিজেদের এমপিদের ওপর নির্ভর করে আইন পাস করতে পারবে না। এর ফলে ‘ঝুলন্ত পার্লামেন্ট’ হবে।
সে পরিস্থিতিতে বৃহত্তম দল সিদ্ধান্ত নিতে পারে অন্য দলের সঙ্গে মিলে জোট সরকার গঠনের। অথবা সংখ্যালঘু সরকার হিসাবে কাজ করতে পারে তারা। কিন্তু সে পরিস্থিতিতে কোনো আইন পাস করার সময় তাদেরকে অন্য দলের ভোটের ওপরই নির্ভর করতে হবে।