পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব: কীভাবে সমাধান হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট?
পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের একটি সংবেদনশীল এবং জটিল অঞ্চলের নাম। এই অঞ্চলে জাতিগত ও রাজনৈতিক উত্তেজনা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে, যার শিকড় অন্তত মুঘল আমল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত বিস্তৃত। সাম্প্রতিক সময়ে দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবানে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, যা বিভিন্ন সংঘর্ষ ও আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। বাঙালি চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা, পাহাড়িদের বাড়িঘরে হামলা এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে পাহাড়িদের প্রাণহানির মতো ঘটনা পার্বত্যাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও অস্থির করে তুলেছে। এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তিন পার্বত্য জেলায় দাঙ্গায় রূপ নেয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বর্তমান পরিস্থিতির গভীরে গেলে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি, সম্পদ ও অধিকার নিয়ে বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব নতুন নয়। ইতিহাস, রাজনীতি এবং সামাজিক বাস্তবতা মিলিয়ে এই অঞ্চলের সংকট দীর্ঘমেয়াদি এবং গভীর।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত এই পাহাড়ি অঞ্চলে অশান্তির ইতিহাস অনেক পুরোনো। এটি অন্তত মুঘল আমল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় ৫০০ বছর আগে, ফিরে যায়। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) গবেষক পপি দেবী থাপা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা তাঁর একটি বইয়ে উল্লেখ করেছেন, চাকমা রাজা মংছুই ১৪১৮ সালে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারের রামু, টেকনাফ এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই থেকে চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন শুরু করে। পরে মারমারাও সেখানে বসতি গড়ে তোলে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় মুঘলরা পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। তাদের মাধ্যমে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বাংলার নবাবদের হাতে। ১৭৬০ সালে নবাব মীর কাশেম আলী পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করেন। তখন চাকমারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে, কিন্তু পরে পরাজিত হয়।
ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজরা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯০০ সালে তারা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন অ্যাক্ট’ জারি করে। এই আইনে সেখানে বসবাসরত পাহাড়িদের অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। এই আইনে ‘অ-উপজাতি’দের সেখানে জমি কেনা নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি কোনও ‘অ-উপজাতি’র ব্যক্তিকে ওই অঞ্চলে যেতে হলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হতো।
ভারত ভাগ থেকে কাপ্তাই বাঁধ, অশান্তির ইতিহাস
ভারত ভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়, যদিও অনেক পাহাড়ি ভারতে যেতে চেয়েছিল। পাকিস্তান হওয়ার পর পাকিস্তানি সেনারা পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে তাদের পতাকা ওড়ায়। তারপর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদা কমাতে থাকে, যা ব্রিটিশরা দিয়েছিল। পপি দেবী থাপা লিখেছেন, এভাবেই পাহাড়িদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া শুরু হয়।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ১৯৯২ সালে লেখেন, “১৯৫৪ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ জেলা হিসেবে গণ্য করা হতো, কিন্তু সেখানকার মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। ১৯৫৫ সাল থেকে এই জেলাকে একটি সাধারণ জেলায় পরিণত করার চেষ্টা শুরু হয় এবং ১৯৬৩ সালে সংবিধান সংশোধন করে এর বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হয়।”
পপি দেবী থাপা আরও লিখেছেন, ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট এক আদেশে বলে যে, যেসব অ-উপজাতি (অর্থাৎ যারা পাহাড়ি নয়) ১৫ বছর বা তার বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে, তারা সেখানে জমি কিনতে পারবে।
“পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সব পরিবর্তন সেখানকার মানুষের মতামত না নিয়েই করা হয়েছিল। এমনকি উন্নয়ন পরিকল্পনাতেও তাদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। বরং কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং নিজের জমি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।”
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র কীভাবে পাহাড়িদের ওপর বড় আঘাত হয়ে এসেছিল, তা আনু মুহাম্মদ তার লেখায় বলেছেন।তিনি লিখেছেন, “পাহাড়ি নেতাদের অনেক বাধা সত্ত্বেও আমেরিকার ঋণের টাকায় ৫ বছর ধরে রাঙামাটিতে কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প করা হয়। এতে এ অঞ্চলের মোট আবাদি জমির ৪০ ভাগ (প্রায় ৫৫ হাজার একর জমি) সহ ২৫০ বর্গমাইল এলাকা পানিতে ডুবে যায়।
“এই প্রকল্পের কারণে প্রায় ১ লাখ চাকমা এবং অন্যান্য আদিবাসী মানুষ (মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ) উদ্বাস্তু হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে ৬০ হাজার কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল ৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার, দেওয়া হয় মাত্র ২৫ লাখ ডলার। এলাকায় ঐতিহ্যগত জুম চাষের পদ্ধতি নষ্ট হয়ে যায়, হাজার হাজার পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান। এই প্রকল্প পুরো এলাকায় এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে।”
অনেক পাহাড়ি যখন উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে যায়, তখন ১৯৬৬ সাল থেকে পরিকল্পিতভাবে পার্বত্যাঞ্চলে বাঙালিদের পুনর্বাসন শুরু হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম: স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে শান্তিচুক্তি পর্যন্ত
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের অনেকেই অস্ত্র হাতে অংশ নেন। তাদের মধ্যে ইউ কে চিং মারমা যুদ্ধকালীন বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম খেতাব লাভ করেন। তবে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়সহ একটি অংশ পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান করেছিল।
স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাতন্ত্র্য চেতনার উত্থান ঘটে। এই সময়ে জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা)। তার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। এম এন লারমা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংসদেও প্রতিনিধিত্ব করেন।
বাংলাদেশের সংবিধান চূড়ান্তকরণের সময় এম এন লারমা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান। তিনি ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি অ-উপজাতীয়দের পার্বত্য এলাকায় বসবাস নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেন। সংসদে তিনি পাহাড়ি জনগণের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরেন।
তবে, সরকারের পক্ষ থেকে তার দাবিগুলোতে সাড়া মেলেনি। বরং ১৯৭৩ সালে পার্বত্য অঞ্চলে সামরিক ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় গঠিত হয় জেএসএসের সামরিক শাখা শান্তি বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন এম এন লারমার ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।
লেখক আনু মুহাম্মদ উল্লেখ করেছেন, ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পর পাহাড়ি জনগণের প্রতি রাজনৈতিক অস্বীকৃতি সামরিক নিপীড়নে রূপ নেয়। সরকারিভাবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দরিদ্র বাঙালিদের অর্থ ও জমির লোভ দেখিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৮০ সালে সমতল থেকে ১ লাখ বাঙালি পরিবারকে পাহাড়ে পুনর্বাসনের জন্য নেওয়া হয়, যা ১৯৭৯ সালে ৩০ হাজার পরিবারের পুনর্বাসনের ধারাবাহিকতা ছিল। ১৯৬০ সালে পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি জনসংখ্যা যেখানে মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ ছিল, ১৯৮৭ সালে তা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ বাঙালি-পাহাড়ি দাঙ্গায় হতাহতের ঘটনা ঘটে, যা পপি দেবী থাপা তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও লেখেন, শান্তি বাহিনী কর্তৃক অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং ১৯৮৪ সালের ৩১ মে বরকলে ১০০ জন বাঙালিকে হত্যার ঘটনাও রয়েছে। পাহাড়িদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ১৯৮৩ সালে এম এন লারমা খুন হন।
এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনামলে, ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর খাগড়াছড়িতে জেএসএসের সঙ্গে সরকারের প্রথম আলোচনা হয়। পরবর্তী দুই বছরে পার্বত্য সমস্যার সমাধানে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নরসীমা রাও বাংলাদেশ সফর করেন।
অনেক পাহাড়ি উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। সেই সময়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা শান্তি বাহিনীকে সশস্ত্র সহযোগিতা করেছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। সরকার জেএসএসের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেলেও, তা ফলপ্রসূ হয়নি এবং সংঘাত চলতে থাকে।
১৯৯২ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য সংকট সমাধানে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী অলি আহমদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। জেএসএসের সঙ্গে আলোচনা চলাকালীন বেশ কয়েকবার অস্ত্র বিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি: প্রেক্ষাপট ও বাস্তবায়ন
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম সংকট সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করে। মন্ত্রিসভা একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে, যার প্রধান করা হয় তৎকালীন সংসদের প্রধান হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে। কমিটিতে আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে বিএনপির দুই সদস্য কমিটির কাজে অংশগ্রহণ করেননি।
কয়েক দফা সংলাপের পর, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে সই করেন সন্তু লারমা ও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় শিল্পী শাহাবুদ্দিনের স্বাধীনতার পতাকা ও বর্ণমালা আঁকা তৈলচিত্রের নিচে রাখা টেবিলের দুই প্রান্তে বসে তারা ১৫ পৃষ্ঠার চুক্তিপত্রে সই করেন। চুক্তি সইয়ের পর উপস্থিত সবাই শান্তির প্রত্যাশায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
তবে চুক্তির পর পাহাড়িদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এর ফলে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) থেকে পৃথক হয়ে গড়ে ওঠে আরেকটি সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। পরবর্তীতে এই দুটি সংগঠন ভেঙে আরও কয়েকটি দল তৈরি হয়, ফলে বর্তমানে চারটি সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় রয়েছে।
শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিরা সম অধিকার আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গঠন করে। পাহাড়িরা যেখানে সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানায়, সম অধিকার আন্দোলন তার বিরোধিতা করে। তাদের আশঙ্কা, চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাঙালিরা পাহাড়িদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।
শান্তি চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সন্তু লারমা বিভিন্ন সময় অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রামের হুমকিও দেন। ২০২৩ সালে তিনি বলেন, চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি, এবং ১৪ বছর ধরে চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। তিনি চুক্তি বাস্তবায়নে পুনরায় বড় লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান।
শান্তি চুক্তির লাভ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ মেজবাহ কামাল ২০২৩ সালে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “শান্তি চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে পাহাড়িদের সহিংসতা বন্ধ হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। সমতলের মানুষের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে চলাচল সহজ হয়েছে। এছাড়াও, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিন পার্বত্য জেলায় জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছে।”
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ক্রয়-বিক্রয়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, পার্বত্যাঞ্চলে ভূমি কেনা-বেচা এবং হস্তান্তর স্থানীয় পরিষদের অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না। এই নীতির বিরোধিতা করছে পার্বত্যাঞ্চল বসবাসরত বাঙালিদের সংগঠন সম অধিকার আন্দোলন।
পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব সম্পর্কে মন্তব্য করে ইতিহাসবিদ মেজবাহ কামাল বলেন, “পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের পুরনো নয়। এক সময় পাহাড়িরাই জমি চাষাবাদের প্রয়োজনে বাঙালিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সম্পর্কটি শুরুতে সুসম্পর্কেরই ছিল এবং আদি বাঙালিরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করত।”
তবে, তিনি উল্লেখ করেন, “রাজনৈতিক বিবেচনায় পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করার উদ্যোগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টার পর থেকেই সেখানে সংকটের সূচনা হয়। বিশেষ করে, বাঙালি সেটেলার কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই এই সংকট ঘনীভূত হয়।”
বর্তমান বিরোধ নিরসনের উপায় সম্পর্কে মেজবাহ কামাল বলেন, “যে জমি এখনও পাহাড়ি জনগণের হাতে আছে, তা যেন তাদের হাতে থাকে এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য যে জমি দরকার, তা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত। অন্যদের প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিলে সমস্যা অনেকটা সমাধান হতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে আদিবাসীদের জন্য নির্ধারিত সীমানা রয়েছে, যেখানে অন্যদের জমি ক্রয়-বিক্রয় বা প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ বা সীমিত করা হয়েছে। একই পদক্ষেপ পার্বত্য চট্টগ্রামে নিলে পাহাড়িদের জীবনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।”
বাঙালিদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে পাহাড়িদের দাবি সম্পর্কে তিনি বলেন, “এই দাবি তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন ক্রমাগত সঙ্কুচিত হওয়ার কারণে উঠে এসেছে। পাহাড়ি অঞ্চলে মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমি সমতলের চেয়ে কম। ফলে তাদের বেঁচে থাকার সুযোগ ক্রমেই সীমিত হয়ে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এখনও এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র, বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারছি না। যদি মাল্টিকালচারাল রাষ্ট্র গঠন করে স্থানীয় মানুষের জমি, জল, এবং জঙ্গলের ওপর তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এভাবে বাংলাদেশের সকল নাগরিক সমান মর্যাদায় বাস করতে পারবে, এবং এই নিশ্চয়তা পেলেই পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।”