চট্টগ্রামনগরজুড়ে

পাহাড়-পুকুরে ভবনের নকশা অনুমোদন, তোপের মুখে সিডিএ

চট্টগ্রামে পাহাড় ও পুকুর শ্রেণির অনেক ভূমির মালিক খতিয়ানে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করছেন। এরপর বড় বড় ভবন বানান। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এসব ভবনের অনুমোদন দিয়ে আসছে। বিষয়টি তুলে ধরে সিডিএকে একহাত নিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট রিজওয়ানা হাসান।

বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) সকাল এগারোটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত নগরীর হোটেল দি পেনিনসুলার ডালিয়া হলে চলা মতবিনিময় সভায় সিডিএ’র প্রতিনিধি ডেপুটি চিফ টাউন প্ল্যানার আবু ঈসা আনসারীর উদ্দেশ্যে তিনি বক্তব্য রাখেন।

এর আগে জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মুহাম্মদ ফখরুজ্জামান সিডিএ’র প্রতিনিধির কাছে জানতে চান কেন পুকুর ও পাহাড়ের জমিতে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় সিডিএ? এমনকি জেলা প্রশাসনও অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে পাহাড় ও পুকুরে সিডিএ’র ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে।

এমন প্রশ্নের উত্তরে সিডিএ’র ডেপুটি চিফ টাউন প্ল্যানার আবু ঈসা আনসারী বলেন, তারা খতিয়ান দেখে অনুমোদন দিয়ে থাকেন। অনেক সময় পাহাড় হলেও খতিয়ানে নাল বা ভিটি থাকে। এজন্য তারা অনুমোদন দিয়ে দেন৷

এরপরই সিডিএ’র প্রতিনিধিকে পাল্টা প্রশ্ন করেন বেলার প্রধান নির্বাহী এডভোকেট রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, আপনারা প্রথমে মালিককে পাহাড় কাটার সুযোগ দেন। এরপর কখন শ্রেণি পরিবর্তন করে সেজন্য বসে থাকেন। আর পাহাড় শব্দটা কেটে নাল বা ভিটি বসিয়ে দেন। তারপর অনুমোদন দিয়ে দেন। সিডিএ হিসেবে আপনার কাজ সেটা না। আপনার কাজ পাহাড় রক্ষা করা। আপনি জানেন আদালতের নির্দেশনা রয়েছে পাহাড় কাটা হলে সেখানে বনজ গাছ লাগাতে হবে। কেন সেটা করেন না আপনারা? আপনি সিএস খতিয়ান দেখেন। সিএস হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট। আপনারা কি চান এই পাহাড় বর্তমান প্রজন্ম দেখে শেষ করে দিক। এরপর ভবিষ্যত প্রজন্ম পাহাড় না দেখুক৷ তাহলে তেমনটাই হবে।

মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মুহাম্মদ ফখরুজ্জামান ভূমিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেবলেন, নগরীর অনেক পাহাড়ে, সরকারি খাসের জমিতে বিভিন্ন এনজিও বসবাসকারীদের পেট্রোনাইজ করছে। স্লাম বানিয়ে তাদেরকে টয়লেট করে দিচ্ছে। ইউএনডিপি’র মতো এনজিও এগুলো করছে। এতে অভিযান পরিচালনায় আমাদের সমস্যা হচ্ছে।

ডিসির উদ্দেশ্যে এডভোকেট রিজওয়ানা হাসান বলেন, চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি খাস জমি রয়েছে। বসবাসের নামে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দখলের মহোৎসব চলছে। উন্নয়নের জন্য নদী, খেলার মাঠ ভরাট করা হচ্ছে। আমার খেলার মাঠও লাগবে, নদীও লাগবে। উন্নয়নও লাগবে। কিন্তু নদী ও খেলার মাঠ এগুলো কোনটাকেই কম্প্রোমাইজ করা যাবেনা। পুনবার্সন শব্দটা আমরা পুরোপুরি বাদ দিতে পারব না। কেননা আমরা সুইজারল্যান্ডে বসবাস করি না। উদ্বাস্তুরা যাবে কোথায়? কিন্তু জঙ্গল সলিমপুরে যা হচ্ছে সেটি পুনর্বাসন নয়। সেটি পুনবার্সনের নামে দখল বাণিজ্য। সেখানে রয়েছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেটাকে বলা হয় আন্ডারওয়ার্ল্ড৷ প্রশাসনকে ধীরে ধীরে সেখানে অভিযান পরিচালনা করে আয়ত্তে আনতে হবে। সরকার যখন কোন পুনবার্সন করতে চায় তখন বলে জায়গা নাই। অথচ চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি খাস জমি। খাস জমির আধিক্য রয়েছে বেশি এই চট্টগ্রামে। কিন্তু কাগজে আছে বাস্তবে নেই বা থাকে না।

আমি ডিসিকে বলব, কোথায় কোথায় খাস জমি আছে সেটার দ্রুত ল্যাণ্ড ডিমার্কেশন করা জরুরি। আমরা দেখি রাজউক প্রায় সময় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয় এই এলাকায় জমি কেনা যাবে না এটা সরকারি জায়গা। এরকম যেই জমিগুলো আপনার অধীনে সেগুলোতে সাইনবোর্ড লাগানো যায়। ৪ টি বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় পত্রিকাগুলোতে। একইসাথে ব্যক্তি মালিকানাধীন যেই পাহাড়গুলো রয়েছে তাদের নোটিশ করা যে আপনি মালিক হলেও আপনি এই পাহাড় কাটতে পারবেন না৷ আপনার সেই অধিকার নাই।

এসময় রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, আমরা ডিসিকে একটি ভলেন্টারি সেবা দিতে চায়। প্রত্যেক ওয়ার্ডে পুলিশ সোর্স থাকে। আমাদের প্রত্যেক ওয়ার্ডে বেলার একজন করে লোক থাকবে। কোথাও পাহাড় কাটা হলে তারা জানাবে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মতবিনিময়ে অংশীজনেরা ডিসির কাছে জানতে চান পাহাড় কাটা বন্ধে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। এসময় ডিসি আবুল বাশার মুহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা ও দণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমাদের ইউএনও-এসিল্যাণ্ডরা নির্ঘুম রাত পার করছেন। গত কয়েকদিন আগেও সীতাকুণ্ডের ইউএনও-এসিল্যাণ্ড অবৈধ দখল উচ্ছেদে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন। তাদের মাথা ফেটে গিয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা পাহাড় কাটা বন্ধে কাজ করে যাচ্ছেন।

এসময় ডিসি আবুল বাশার মুহাম্মদ ফখরুজ্জামান পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধির কাছে জানতে চান তাদের ভূমিকা নিয়ে? কেউ আটক হয়েছেন কিনা? কেউ শাস্তি পেয়েছেন কিনা? উত্তরে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, আমরা নিয়মিত করে যাচ্ছি। জরিমানাও করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আইনটি জামিনযোগ্য। তাই আসামিরা আটক হলেও আবার জামিন নিয়ে বেরিয়ে চলে আসছে। আইনটি সংশোধন করা দরকার।

মতবিনিময় সভায় চসিকের কাউন্সিলর জহুরুল হক জসিমের পাহাড়কাটা, বেলার প্রতিনিধি দলের উপর হামলাসহ নানা পরিবেশ বিধ্বংসী ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ব্যাপক সমালোচনা করেন সচেতন নাগরিক ও পরিবেশ কর্মীরা। এসময় আদালতে তার বিরুদ্ধে চার্জগঠন হওয়ার পরও কেন তাকে বরখাস্ত করা হয়নি সে বিষয়ে জানতে চান তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d