ফ্রিল্যান্সিংয়ের টাকায় নান্দনিক ‘রেডিমেড’ ঘর
ওমর ফারুক (২৯)। ৪ বছর আগে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনমিকস এণ্ড ব্যাংকিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করছেন। বন্ধুরা চাকরির পেছনে ছুটলেও ফারুক ফ্রিল্যান্সিংয়ে মনোনিবেশ করেন। একসময় কোরিয়ান একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন তিনি। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি৷ ঘরে বসেই প্রতি মাসে আয় করতে থাকেন প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
ফারুকের অনেক দিনের স্বপ্ন কন্টেইনার দিয়ে পরিবারের জন্য একটি বাড়ি বানাবেন। এজন্য বছর কয়েক আগে কিনে রাখেন এক টুকরো জমিও। তবে কন্টেইনারের দাম বেশি হওয়ায় সেটা করা সম্ভব হয়নি তার। এক বছর আগে মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং এলাকায় ঘুরতে যান তিনি। ঘুরতে গিয়ে সেখানকার কাঠপট্টি বাজারে তার চোখে পড়ে কাঠের কারুকার্যময় বিশেষ দোতলা ঘর (রেডিমেড ঘর)। ঠিক করলেন এই ঘরই কিনে নেবেন। আর নিজ গ্রাম সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের কাজিপাড়ায় মনের মতো করে সাজাবেন।
ফারুকের যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মাসখানেক আগে পুনরায় মুন্সিগঞ্জের ‘কাঠের ঘরের’ সেই হাটে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকেন ‘রেডিমেড’ সব ঘর। অবশেষে পছন্দমতো একটি ঘর ১০ লাখ টাকায় কিনে নেন তিনি। সপ্তাহখানেক পরেই মুন্সিগঞ্জের বিক্রেতা লিখে দেওয়া ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন ওমর ফারুকের কেনা ঘরটি। সাথে দেওয়া হয় ১০ জন শ্রমিক।
লৌহজং কাঠপট্টি বাজারে ফারুক যেই ঘর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন, সেই ঘরের প্রতিটি অংশ খুলে আনা হয়েছে ট্রাকে যোগে। কাজিপাড়া গ্রামে আনার পর ফারুকের কেনা জমিতে ঘরটি লাগানো হয়। ভিত হিসেবে ২৪টি কংক্রিটের পিলার ঢালাই দেওয়া হয়। চারদিকে ইটের গাঁথুনি করার পর একে একে লাগানো হয় দরজা, চৌকাঠ, ছাদ, সিঁড়ি, বেলকনি থেকে শুরু করে সবকিছু। মাত্র ১ সপ্তাহে পুরো ঘরটি সাজিয়ে তোলা হয়। এরপর মুন্সিগঞ্জের শ্রমিকরা বিদায় নিয়ে চলে যায়৷
বর্তমানে ফারুক ও তার ভাইয়েরা ঘরটিতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করছেন। টেকসই করতে ঘরটির কাঠের অংশগুলোতে বেশি করে মোবিল (বিশেষ তেল) লাগানো হচ্ছে। দূর দূরান্ত থেকে দৃষ্টিনন্দন এই ঘর দেখতে প্রতিদিন বহু মানুষ সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন। কেউ কেউ ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন৷ পরে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করছেন। আশেপাশের এলাকায় ওমর ফারুকের ঘরটি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ঘরটি ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি দরজায় বিশেষ কারু কাজ করা হয়েছে। নিচতলায় সামনে একটি প্রশস্ত বারান্দা রয়েছে। পেছনে দুটি কক্ষ ও উপরে ওঠার নান্দনিক সিড়ি। প্রতিটি কক্ষে রয়েছে ৬টি করে জানালা। দোতলায়ও রয়েছে দুটি কক্ষ ও একটি দৃষ্টিনন্দন বেলকনি। যেখান থেকে প্রকৃতিকে উপভোগ করা যাবে দারুণভাবে। জানালার সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রচুর আলো-বাতাস প্রবেশ করছে ঘরটিতে। এছাড়াও ঘরটির ছাদের নিচে রয়েছে বিশেষ সেলফ, যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা যাবে অনায়াসেই। ঘরটির পেছনের এক পাশে আলাদা ওয়াশরুম ও রান্নাঘর নির্মাণ করেছেন ওমর ফারুক।
ওমর ফারুকের প্রতিবেশি রহিমা বেগম জানান, এমন ঘর তিনি কখনও দেখেননি৷ নিজের বাড়ির পাশে এরকম সুন্দর ঘর দেখে তার খুব ভালো লাগছে।
কৃষক আব্দুল আলী জানান, প্রতিদিন ঘর দেখতে মানুষ তাদের গ্রামে ভিড় করছে। দূর থেকে আলাদা করে চোখে পড়ছে। মূলত ব্যতিক্রমী হওয়ায় সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ঘরটি।
ওমর ফারুকের ভাই হারুনুর রশিদ বলেন, ঘরটি নির্মাণে লোহা, কাঠ আর জাপানি প্লেইন সিট ব্যবহার করা হয়েছে। এটি টেকসই করতে তেল লাগানো হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পুরো ঘর খুলে অন্যত্র সরানো যাবে৷ ভিন্নরকম ঘর পেয়ে আমাদের পরিবারের সবাই খুশি। মূলত ছোট ভাইয়ের ইচ্ছে ছিল এরকম বাড়ি করার।
ওমর ফারুক বলেন, আমি ফ্রিল্যান্স করে মাসে অর্ধলক্ষ টাকা আয় করি। সেখান থেকে কিছু টাকা জমিয়েছি। সেগুলোর সাথে আমার ভাইয়ের টাকাসহ যোগ করে ১০ লাখ টাকায় বাড়িটি কিনেছি। এখানে আরও ৩ লাখ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। দ্রুত পরিবার নিয়ে এ বাড়িতে বসবাস শুরু করব। আমার অনেক দিনের শখ ছিল ভিন্নরকম একটি বাড়ি করব৷ আজ স্বপ্ন পূরণ হলো।
জানা যায়, মুন্সিগঞ্জ জেলায় পদ্মা নদী ও মানিকগঞ্জ জেলায় কালিগঙ্গা, ইছামতি ও ধলেশ্বরী নদী ভাঙনের ফলে প্রতিবছর সেখানকার শতশত মানুষ তাদের বাড়িঘর হারায়৷ নদী ভাঙনের কবল থেকে বাড়িঘর রক্ষায় ওইসব এলাকায় কাঠের দোতলা ঘরের প্রচলন শুরু হয় অনেক আগে থেকে। কেননা এই ধরণের বাড়ি নদী ভাঙন কিংবা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় খুলে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা যায়৷ তবে ইদানিং এসব ঘর শখের বসে সারাদেশের মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। পর্যটন স্পটগুলোতে হোটেল-রিসোর্ট ব্যবসায়ীরাও এসব ঘর কিনে রিসোর্ট বানাচ্ছেন। কেউ কেউ বাগান বাড়ি বানাচ্ছেন দোতলা, তিনতলা, চারতলা, সাততলা পর্যন্ত- এসব ঘর দিয়ে।