বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ- অভিন্ন সত্তা
বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে হয়তো বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্ম হতো না। টুঙ্গিপাড়ার ছোট্ট খোকা বড় হয়ে নিজ দেশের ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য অদম্য আগ্রহ পোষণ করবে তা কেউ ভাবেনি এ যেন দেশমাতৃকার কাছে তাঁর একমাত্র বায়না স্বাধীনতা পেতেই হবে যে কোনও মূল্যে। মায়ের কোলের খোকা, বন্ধুদের মুজিব ভাই, জনগণের ভালোবাসায় শিক্ত হয়ে উপাধি পান বঙ্গবন্ধু। অখণ্ড পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার টোপকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতার প্রশ্নে অটল ছিলেন বলেই তিনি পরবর্তিতে হয়ে উঠেন অবিসংবাদিত নেতা ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। উনি ছিলেন দেশ ও দেশের মানুষের প্রকৃত অভিভাবক, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা।
দেশের জনগণের দেয়া উপাধি ‘বঙ্গবন্ধু’ একসময় দেশ পাগল মানুষটির নামে পরিণত হয়। গোটা বিশ্ব দেখে দেশপ্রেমিক মুজিবের অদম্য সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রতিকূল অবস্থায় অটল থাকার ক্ষমতা যা তাঁর সমসাময়িক অন্য নেতার মধ্যে ছিল না। তাঁর সম্পর্কে বলা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর উক্তিটা তাই যথাযথ– In Personality and in courage this man is Himalayas দেশের ও দেশবাসীর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রমাণ মিলে বারংবার।
ডেবিট ফ্রস্টকে (সাংবাদিক) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন – ‘I feel for my country and then my family ’ জনগণের উদ্দেশ্যে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন– ‘আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি–কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যাতে এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারি।’ তাঁর সাথে জনগণের একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল। আর তাঁর উপর ছিল জনগণের অগাধ আস্থা ও ভালোবাসা। তাই স্বাধীনতার স্বপ্নে মগ্ন করার বীজমন্ত্রটি তিনি জনগণের অন্তরের মণিকোঠায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি আরো রক্ত দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’– বজ্রকণ্ঠে দেয়া ভাষণের এই বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল জনগণ। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সম্মুখ সমরে। এই যাদুকরী ভাষণেই ছিল মুক্তির ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক। এরপর উত্তাল মার্চের হাত ধরেই স্বাধীনতার পথে যাত্রা।
একজন প্রাজ্ঞ ও কূটনৈতিক কৌশলের অধিকারী হিসাবে তিনি জানতেন কীভাবে দেশকে রক্ষা করতে হবে এবং ভুট্টো–ইয়াহিয়াকে পরাস্ত করতে হবে। তাই তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে বিরত ছিলেন ঠিকই, কিন্ত পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন। শত্রুর পাতানো ফাঁদে পা না দিয়ে, ১৮ মিনিটের পাণ্ডুলিপিবিহীন মহাকাব্যে এই প্রাজ্ঞ নেতা সবই বলেছিলেন। তাই পরের দিন আই.এস.আই রিপোর্ট করেছিল-‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সাথে বক্তৃতা করেছে।’ ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামের নির্মম হত্যাযজ্ঞ বঙ্গবন্ধুকে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছিল। তাই তিনি ২৬শে মার্চ ১ম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বিচক্ষণতার সাথে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন– ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ পাকিস্তানি শাসকচক্র মনে করেছিল এই ঘোষণা তিনি ৭ই মার্চ দিবেন। তারা ট্যাংক ও মেশিনগান নিয়ে প্রস্তুত ছিল জনতা ও জনতার নেতাকে আক্রমণের জন্য। এই অগ্নিপুরুষের কূটনৈতিক বিশেষত্ব ছিল অপরিসীম, তাই তাদের সকল পরিকল্পনা ব্যাহত হয়।
১৯৭২ এর ৬ই ফেব্রুয়ারি উনি যখন কলকাতায় যান তখন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, ‘আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ সবকিছুর জন্য। এখন আর একটা অনুরোধ, ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ থেকে তুলে নিলে কেমন হয়!’ ইন্দিরা গান্ধী একটু ভেবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন– ‘১৭ই মার্চ সরিয়ে নিবো।’ ১৭ই মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। তাঁর স্বপ্ন ছিল অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্য ও শোষণমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার।
এদেশের রাজনীতিতে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল অনবদ্য। ১৯৪৮ এর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট, ৫৮ এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন ও ৭১ এর বাঙালির মুক্তির অধিকার আদায়ের উত্তাল আন্দোলন, প্রত্যেকটিতে তিনি মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। কারাগারে বন্দী অবস্থায় তাঁর ফাঁসির হুকুম দেয়া হলে তিনি বলেন. ‘আমি তাদের কাছে নত স্বীকার করবো না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় বলবো,আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অসামান্য অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ কালক্রমে এক অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে।
সূত্র: ১. স্বাধীনতার মহাকাব্য (প্রবন্ধ)-তোফায়েল আহমেদ, ২. তিনিই বাংলার মুক্তির ইতিহাস (প্রবন্ধ)-তোফায়েল আহমেদ।
লেখক: গোপা রাণী দে, সহকারী অধ্যাপক, নুরুল হক ডিগ্রী কলেজ, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।