বঙ্গবন্ধু টানেলের সুফল আটকে যেতে পারে সংযোগ সড়কে
বঙ্গবন্ধু টানেলে পাল্টে যেতে পারে এ অঞ্চলের অর্থনীতি।কর্ণফুলী নদীতে নির্মিত এই টানেল চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে। মাতারবাড়ীতে চলমান ৭২টি মেগা প্রকল্পের সঙ্গে মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে হতে যাওয়া পাঁচ শতাধিক কারখানার যোগসূত্রও স্থাপন করবে এই টানেল।
টানেল তৈরি হলেও সেভাবে প্রস্তুত হয়নি সড়কপথ।চার লেইন হয়নি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের পুরোটা। টানেলের প্রবেশমুখেও জট লাগতে পারে গাড়ির। কারণ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে রিং রোডের মিলনস্থলে যে জংশন আছে, সেটিও পর্যাপ্ত প্রশস্ত নয় বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেজ্ঞরা।
এর প্রশস্ততা বাড়াতে কাজ করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। নতুন করে প্রকল্প গ্রহণ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও। তারা বলছে, টানেল দিয়ে শুরুতে প্রতিদিন চলবে ১৭ হাজার গাড়ি। বিদ্যমান সড়ক ব্যবস্থাপনায় গাড়ি চলাচল করতে কোনো অসুবিধা হবে না। ভবিষ্যতে গাড়ি চলাচল বাড়তে থাকলে সড়কও পর্যায়ক্রমে প্রশস্ত হবে।
ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে আসা কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী গাড়ি চট্টগ্রাম টোল রোড ও চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে পতেঙ্গা দিয়ে টানেলে প্রবেশ করবে। সংযোগ সড়ক হয়ে এসব গাড়ি আনোয়ারার চাতরী চৌমুহনীতে সংযুক্ত হবে। এর পর গাড়িগুলো চলে যাবে পিএবি সড়ক হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা ওয়াই জংশনে। টানেলের সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হলেও পিএবি সড়কের চাতরী চৌমুহনী মোড় থেকে আসা গাড়িগুলো শিকলবাহা ওয়াই জংশনে এসে মিশবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে। কিন্তু সেই মহাসড়ক এখনও দুই লেনের।
ভবিষ্যতে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর চালু হলে এই মহাসড়কে গাড়ি চলাচল বাড়বে। কিন্তু বর্তমানে মহাসড়কটির প্রশস্ততা গড়ে মাত্র ১৮ ফুট। এই মহাসড়ক চাপ নিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, ‘টানেলের সুফল নির্ভর করবে সংযোগ সড়কের ওপর। উদ্বোধনের সঙ্গে সংযোগ সড়কগুলোর কাজ শতভাগ শেষ করতে হবে। তা না হলে আমরা টানেলের পুরো সুফল পাব না।’
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘টানেলের সুফল পুরোপুরি পেতে হলে সড়ক অবকাঠামো ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে। এ জন্য বেশ কিছু নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এগুলোর কাজ যথাযথ মান রেখে দ্রুত শেষ করতে হবে।’ ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ‘টানেলকে ঘিরে নদীর দুই পাড়ে বিস্তৃত হবে শিল্পকারখানা। তখন গাড়ির চাপ আরও বাড়বে। তাই টানেল সংশ্লিষ্ট সংযোগ সড়ক নিয়ে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে আন্তরিকভাবে।’
টানেল ব্যবহার করা গাড়ি যাবে তিন পথে।দীর্ঘ কর্মযজ্ঞ শেষে বঙ্গবন্ধু টানেল এখন গাড়ি চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। ২৮ অক্টোবর উদ্বোধনের পরদিনই টানেল দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে। সারাদেশ থেকে কক্সবাজারগামী গাড়ি পতেঙ্গা হয়ে টানেল পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সড়ক ধরে কক্সবাজার যাবে। টানেল থেকে বের হয়ে আনোয়ারা প্রান্তের সংযোগ সড়কটি পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী (পিএবি) সড়কের সঙ্গে চাতরী চৌমুহনী এলাকায় সংযুক্ত হয়েছে। টানেল পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারগামী যানবাহন পিএবি সড়কের সংযোগস্থল থেকে তিনটি রাস্তা দিয়ে কক্সবাজারের দিকে যেতে পারবে। উত্তরে কর্ণফুলী থানার শিকলবাহা ক্রসিং ও পটিয়া হয়ে আরাকান সড়ক দিয়ে কক্সবাজার গেছে প্রথম রাস্তাটি।
দ্বিতীয় রাস্তাটি পিএবি সড়কের সংযোগস্থল থেকে কালাবিবির দীঘির মোড় হয়ে পূর্বে আনোয়ারা উপজেলা হয়ে চন্দনাইশে আরাকান সড়কে উঠেছে। তৃতীয় রাস্তাটি পিএবি সড়কের সংযোগস্থল থেকে দক্ষিণে বাঁশখালী ও পেকুয়া হয়ে চকরিয়ার ওপর দিয়ে চলে গেছে কক্সবাজার। সরকার ইতোমধ্যে পিএবি সড়কের আনোয়ারা থানার কালাবিবির মোড় থেকে কর্ণফুলী থানার শিকলবাহা মোড় পর্যন্ত ছয় লেনে উন্নীতকরণের কাজ শেষ করেছে। কিন্তু আনোয়ারা প্রান্ত থেকে তিনটি সড়কে যানবাহনগুলোর কক্সবাজার যাওয়ার সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগ যানবাহনই এ ক্ষেত্রে বাঁশখালীর সড়কটিকেই বেছে নিতে চাইবে। বিশেষ করে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও জিপ বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজার যাবে। টানেল থেকে বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজারের দূরত্ব অন্য দুটি পথের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু বাঁশখালীতে বর্তমান সড়কটি দুই লেনের; যা বেশি সংখ্যক গাড়ির চাপ সামলানোর উপযুক্ত নয়। এই সড়ক চার লেনে উন্নীত করার দাবি উঠেছে।
আটকে আছে সংযোগ সড়কের কাজ।ভূমি জটিলতায় আটকে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের সংযোগ সড়কের কাজ। উদ্বোধনের প্রহর গুনলেও সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ মাত্র পাঁচ স্থানে সড়কের দুই লেন চালু করতে পেরেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে সড়কের কয়েকটি অংশে চার লেনের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। টানেলের প্রবেশদ্বার চাতরী চৌমুহনী বাজারের দক্ষিণে কালাবিবির দীঘি বেলচুড়া মৌজা, চৌমুহনী বাজার চাতরী মৌজা, মিয়াবহাট বড়উঠান মৌজা, ফাজিলকার হাট দৌলতপুর মৌজা, ফকিরনির হাট শাহমিরপুর মৌজা– এ পাঁচ স্থানে ছয় লেনের মধ্যে সড়কের দুই লেনের কাজ শেষ হয়েছে। কর্ণফুলীর তীরে আনোয়ারা প্রান্তে শিকলবাহার ওয়াই জংশন থেকে আনোয়ারা সদর ও কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত সংযোগ সড়কের কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি সড়ক ও জনপথ বিভাগ। আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের কাজ শেষ করা না গেলে টানেলের সুফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন বিশিষ্টজন। তারা বলছেন, এই সমস্যা নিরসনে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তা যেন দ্রুত শেষ করে সংস্থাগুলো।
একাধিক নতুন প্রকল্প জংশন ঘিরে টানেলের প্রবেশমুখ প্রশস্ত করতে নেওয়া হয়েছে একাধিক প্রকল্প। টানেলের জংশনে এক পথে চলা নিশ্চিত করার জন্য নির্মাণ করা হবে দুটি ফ্লাইওভার ও দুটি আন্ডারপাস (মাটির নিচ দিয়ে চলাচলের পথ)। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ইপিজেডকে আউটার রিং রোডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। ইপিজেডের পণ্য ও কাঁচামালবাহী গাড়ি শহরে প্রবেশ না করে রিং রোড হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাবে। এ জন্য দুই লেইনের দুটি সেতু (ভায়াডাক্ট) নির্মাণ করা হবে। এগুলো নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২১ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড (দ্বিতীয় পর্যায়) নামে আরেকটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এর আওতায় আছে ফিডার রোড-২। এটি আউটার রিং রোড যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত সম্প্রসারণ এবং সার্ভিস সড়ক নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
তৈরি হবে ১৬৮ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ।সরকার মিরসরাই থেকে আনোয়ারা-বাঁশখালী-পেকুয়া হয়ে বঙ্গোপসাগরের তীর দিয়ে কক্সবাজার শহর পর্যন্ত ১৬৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সড়ক নির্মিত হলে উপজেলাগুলোর উপকূলবর্তী এলাকা অনেক উন্নত হবে এবং সারাদেশের মানুষ টানেল হয়ে মেরিন ড্রাইভ দিয়েই কক্সবাজার যেতে পারবে। মেরিন ড্রাইভের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণে বাঁশখালী উপজেলা উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি। উপজেলার পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগর। এখানে রয়েছে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত। সরকার এই সৈকত উন্নয়নেরও পরিকল্পনা নিয়েছে।