আন্তর্জাতিক

বাড়ির লোক হলেই চাকরি দেন তিনি!

একই দিনে একই পদে নিয়োগ, তবে কারও বেতন বেশি, কারও কম। কেউ কেউ বেতনের চেয়েও বেশি টাকা তুলছেন। আবার, প্রভাষক পদের চেয়েও বেশি নিরাপত্তা কর্মকর্তার! এমন ‘মনগড়া’ বেতনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) অন্তত ১৫ জনকে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়েছেন দুবার বদলি ঠেকানো বিদায়ী সচিব খালেদ মাহমুদ। যাদের মাথায় এমন ‘আশীর্বাদের’ হাত তারা প্রত্যেকেই সদ্য সাবেক সচিবের ‘বাড়ির লোক’। আছেন সচিবের মেয়ে এবং তার বান্ধবীও। বাড়ির লোক হলেই চাকরি দেন তিনি!

সিভয়েস২৪ এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বিদেশ সফরকালীন সময়ে গদিতে বসে এই নিয়োগকাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি। যেখানে মানা হয়নি স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, জরুরি প্রয়োজনে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ দিতে পারবে সিটি করপোরেশন। তবে এ জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু এসব নিয়মের ধার ধারেননি চসিকের সদ্য সাবেক সচিব খালেদ মাহমুদ।

অনুসন্ধান এবং নথিপত্রের তথ্য বলছে, চসিকের সদ্য সাবেক সচিব খালেদ মাহমুদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের পূর্ব কিছমত জাফরাবাদ গ্রামে। তাই তিনি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেন ‘ঘরের লোকদের’। এমন কি সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন নিজের মেয়েকেও। তবে এখানেও রয়েছে ব্যতিক্রম। সম্প্রতি ‘প্রভাষক’ পদে অস্থায়ী নিয়োগ পেয়েও দুজন ‘সহকারী প্রোগ্রামার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন চসিকের আইটি শাখায়।

‘বাড়ির লোক’ তাই বেতন বেশি

গত বছরের সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত কলেজে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের প্রভাষক পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় দুজনকে। এদের একজন হলেন নগরের পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলী এলাকার ইমতিয়াজ উদ্দিন ভুঁইয়া এবং অপরজন মিরসরাই পৌরসভার পূর্ব মিরসরাই গ্রামের মো. তানভীর হোসেন।

একইদিনে ওই নিয়োগ আদেশে স্বাক্ষর করেন চসিক সচিব খালেদ মাহমুদ। নিয়োগ আদেশ দুটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একইদিনে একই পদের জন্য নিয়োগ আদেশ দুটি জারি করা হলেও ইমতিয়াজ উদ্দিন ভুঁইয়ার বেতন ধরা হয়েছে সর্বসাকুল্যে ১৭ হাজার ১শ’ টাকা। কিন্তু একই পদে নিয়োগ পাওয়া মো. তানভীর হোসেনের বেতন ধরা হয়েছে ২০ হাজার ১শ’ টাকা। তাদের দুজনকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা কাজ করছেন চসিকের আইটি শাখার ‘সহকারী প্রোগ্রামার’ হিসেবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মো. তানভীর হোসেনের বাবা মো. মীর হোসেনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে চসিকের সদ্য সাবেক সচিব খালেদ মাহমুদের। আর সেই সম্পর্কের জেরেই বন্ধুর ছেলেকে নিয়োগ দিয়ে বেতন বেশি ধরেছেন তিনি। এ ছাড়া একটি সূত্র বলছে, প্রতিটি নিয়োগে মোটা অঙ্কের কমিশন ঢুকেছে খালেদ মাহমুদের পকেটে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চসিকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শুধু মিরসরাই বাড়ি বলেই বেশি বেতনে ইচ্ছেমতো নিয়োগ দিয়েছেন সচিব স্যার। কারণ ওনার বাড়িও মিরসরাইতে। তার বিরুদ্ধে এমন স্বজনপ্রীতির অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন নিয়োগে তিনি স্বজনপ্রীতি করে অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। আর এসব নিয়োগের ক্ষেত্রেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। উনি বদলি হয়ে গিয়েছেন, এখন আর এসব বলেও বা লাভ কি? নিয়োগ অনিয়ম করে যা দেওয়ার তাতো করেই গিয়েছেন।’

অস্থায়ী পদে শিক্ষক নিয়োগে বেতনের হেরফেরের বিষয়ে চসিকের শিক্ষা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জুরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব আমরা দেখি না। এসব কার্যালয়ের কর্মকর্তারা দেখেন। তাই এ বিষয়ে আমি বলতে পারবো না।’

একই দিনে একই পদে অস্থায়ী নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট এলাকার মানুষ হলেই বেতন বেড়ে যায় কীভাবে— এমন প্রশ্নের জবাবে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘এটা আমার আসলে জানা নেই। এরকম তো হওয়ার কথা না আসলে। আর নির্দিষ্ট এলাকা দেখে বেতন বেশি-কম হতে পারে না।’

বাবার জোরে কপাল খুললো মেয়ের

২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে নিজের মেয়ে শায়লা শারমিন মুমুকে চসিক পরিচালিত কলেজের প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন সচিব খালেদ মাহমুদ। এক্ষেত্রেও তিনি ‘বুড়ো আঙুল’ দেখিয়েছেন সরকারি চাকরিবিধিমালাকে। শুধু তাই নয়, প্রভাষক পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেলেও তার মেয়ের বেতন ধরা হয়েছিলো সর্বসাকুল্যে ২৬ হাজার ৫০০ টাকা। যা একই পদে নিয়োগ করা অন্যান্য প্রভাষক থেকেও অনেক বেশি।

অভিযোগ আছে, নিজের আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে প্রভাব খাটিয়ে অন্তত ১৫ জনকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন বিভাগে চাকরি দিয়েছেন সদ্য সাবেক এই সচিব। পদোন্নতি ও নিয়োগ বাণিজ্য, ঠিকাদারির অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট লালন করে বিপুল অর্থ বৈভবের মালিক হয়েছেন খালেদ মাহমুদ। সেই সিন্ডিকেটের ফরমায়েশ অনুযায়ী কাজ না দেয়ায় চসিকের আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীর ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা।

প্রভাষকের চেয়েও বেতন বেশি নিরাপত্তা কর্মকর্তার!

গত বছরের ৩১ অক্টোবর অস্থায়ী ভিত্তিতে চসিকের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সীতাকুণ্ড উপজেলার পূর্ব মুরাদপুর গ্রামের আবুল কালাম আজাদকে। তার নিয়োগ আদেশে বেতন ধরা হয় সর্বসাকুল্যে ২৩ হাজার টাকা। যা প্রভাষক পদধারীদের চেয়েও প্রায় ৬ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ, এখানেও ইচ্ছেমাফিক বেতন নির্ধারণ করেছেন চসিকের সাবেক সচিব।

চসিকের শীর্ষ পদের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রধান নির্বাহী স্যার যখন দেশের বাইরে ছিলেন তখনই সচিব সাহেব ইচ্ছেমতো বেতন নির্ধারণ করে এসব বিতর্কিত নিয়োগকাণ্ড ঘটিয়েছেন। আর আমাদের করপোরেশনে এগুলোর বিষয়ে যাদের তদারকি করার কথা তারা মাথাই ঘামান না। মূলত চিফ স্যার বিদেশে গেলে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পান সচিব খালেদ মাহমুদ। মূলত সেই সময়টাকেই টার্গেট করেন তিনি। ইচ্ছেমতো মজুরি নির্ধারণ করে নিজের পছন্দের লোককে নিয়োগ দেন।’

অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া নিরাপত্তা কর্মকর্তার বেতন প্রভাষকের বেতনের চেয়েও বেশি হতে পারে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে এই বেতন কাঠামো কীভাবে ধরা হয়েছে আমি জানি না। আমি ওই সময় ছিলাম না। আর যাদের কথা বললেন আপনি, তারা কত টাকা বেতন নেয় তাও আমি জানতাম না। যদি কেউ বঞ্চিত হয়ে থাকে বা বৈষম্যের শিকার হয়; আমাকে বললে বিষয়টি অবশ্যই দেখতাম। এখন এটা আমি দেখবো।’

চসিকের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির চৌধুরী (ভারপ্রাপ্ত) বলেন, ‘আমিতো অ্যাপয়েন্টমেন্ট কার্ড পাই না। আমাকে বেতন বিল যেভাবে প্রস্তুত করে দেওয়া হয় সেভাবেই বেতন বুঝিয়ে দিই আমি।’

জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের যে অর্গানোগ্রাম সেই অনুযায়ী যারা স্থায়ী আছেন তারা একটা গ্রেডে বেতন পান। সরকারের যে বেতন স্কেল আছে তাদের ক্ষেত্রে সেটা ফলো করি। অস্থায়ী যারা তাদের ক্ষেত্রে এরকম কোনো নীতিমালা নেই। এক্ষেত্রে হয়তো মেয়র মহোদয় তাদের যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে বেতনটা নির্ধারণ করে থাকেন।’

তিনি বলেন, ‘ যারা অস্থায়ী তাদের কোনো বেতন স্কেল নেই। তাদের ক্ষেত্রে আমরা স্ট্যান্ডার্ড দৈনিক মজুরি পে করি।’

মজুরি ১৩ হাজার, তোলেন ১৭ হাজার!

চসিক এবং নিয়োগ আদেশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৩ জুলাই মোহাম্মদ হাসান এবং ৪ সেপ্টেম্বর সেলিম উদ্দিনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই পদে গিয়াস উদ্দিন নামে আরও একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে তাকে কবে নাগাদ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেই তথ্য পাওয়া যায়নি। তাদের তিনজনকে ‘কাজ নাই মজুরি নাই’ ভিত্তিতে ৪৫২ টাকা দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

অর্থাৎ তারা যেদিন কাজ করবেন না, ওই দিন কোনো মজুরি দেওয়া হবে না। তাদের তিনজনের বাড়িই মিরসরাই উপজেলায়। এর মধ্যে সেলিম উদ্দিনের বাড়ি মিরসরাইয়ের পূর্ব কিছমত জাফরাবাদে এবং হাসানের বাড়ি জোরারগঞ্জ থানার নাহেরপুর গ্রামে।

তাদের নিয়োগ আদেশে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ‘এই আদেশ চাকরি স্থায়ীকরণের নিশ্চয়তা দেবে না। চাকরিকালে কোনো ধরনের অতিরিক্ত ভাতা পাবেন না। নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি করপোরেশনের আদেশ পালনে বাধ্য থাকবেন। আর কোনো প্রকার কারণ দর্শানো ছাড়া যেকোনো সময় নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে সিটি করপোরেশন। এ জন্য কোনো প্রকার আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন না ওই ব্যক্তি। আর চাকরি ছাড়তে চাইলে ৩০ দিন আগে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী কর্মচারীদের দেওয়া গত বছরের অক্টোবর মাসের বেতনের একটি নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ওই নথিতে দৈনিক ৪৫২ টাকা মজুরিতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সবাই ১৩ হাজার ৫৬০ টাকা করে বেতন তুলেছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু গিয়াস উদ্দিন, সেলিম উদ্দিন ও মোহাম্মদ হাসান। তারা তুলেছেন ১৭ হাজার ১শ’ টাকা করে।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে অভিযুক্ত সাবেক সচিব খালেদ মাহমুদের সঙ্গে একাধিকবার কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি। গত শনিবার তাকে ফোন করা হলে প্রথমবার রিসিভ করে কেটে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

চেয়ার আঁকড়ে রাখতে পারলেন না সচিব খালেদ মাহমুদ

দুই দফা বদলি ঠেকিয়ে শেষমেশ চেয়ার ছাড়তে হয়েছে সচিব খালেদ মাহমুদকে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি অবমুক্ত হয়ে কর্মস্থল ছেড়েছেন তিনি। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তাকে অবমুক্তির নোটিশ জারি করে চসিক।

২০২১ সালের ৯ মার্চ বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের সচিব পদ থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সচিব পদে পদায়ন করা হয় খালেদ মাহমুদকে। এরপর থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উপ-পরিচালক (স্থানীয় সরকার) হিসেবে প্রথমবার বদলি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই বদলি ঠেকিয়ে বহাল থাকেন তিনি।

২০২৩ সালের ১৭ জুলাই খালেদ মাহমুদকে আবারও বদলি করা হয়। ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট খালেদ মাহমুদের বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। পরে কাজী শহিদুল ইসলামকে চট্টগ্রাম ওয়াসায় বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক হিসেবে পদায়ন করা হয়। এবার বদলি করা হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান হিসেবে। একইদিন সরকারি আবাসন পরিদফতরের উপ-পরিচালক কাজী শহিদুল ইসলামকে সিটি করপোরেশনের সচিব পদে পদায়ন করা হয়। তিনি যোগদান করলেও খালেদ মাহমুদ দায়িত্ব না ছাড়ার কারণে চেয়ারে বসতে পারেননি কাজী শহিদুল ইসলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d