বিজয়োল্লাসে গিয়ে ঠাঁই হলো হাসপাতালে
এখনো হাসপাতালের ভেতরে দু-পায়ে ভর করে একটু-আধটু হাঁটাহাঁটি করছে ১৪ বছরের কিশোর মোমিনুল ইসলাম। তাও পা বেঁকিয়ে। এর মধ্যেই কদমে কদমে পরিবারের খরচ, সাপ্তাহিক ঋণের চিন্তা ঘুরছে তার মাথায়। তাইতো আবারো ব্যাটারিচালিত রিকশার স্টিয়ারিং হাতে সড়কে নামার মনস্থির করে ফেলেছে হাসপাতালে বসেই।
চট্টগ্রাম নগরের ঈদগাঁ এলাকায় মোমিনুলের বসবাস। চার ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট সে। পরিবারের টানাপোড়েনের কারণে এ বয়সেই ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে ছোট্ট মোমিনুলকে। দিনভর রিকশা চালিয়ে যা আয় করতো ধরা পড়লেই তার অর্ধেকের বেশি চলে যেতো ট্রাফিক পুলিশের পকেটে। সেই ক্ষোভ থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিজয়োল্লাস করতে নামে। একপর্যায়ে টাইগারপাস এসে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়।
৫ আগস্ট বিকেল থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ২ নম্বর ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন মোমিনুল। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আরেকটু সুস্থ হলেই তাকে রিলিজ দেওয়া হবে।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মোমিনুল ইসলাম বলেছে, ‘গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের খবরে গাড়ি (অটোরিকশা) বন্ধ করে বিজয় উল্লাস করতে টাইগারপাসে আসি। এসে সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর সিআরবিতে গোলাগুলির শব্দ শুনি। আবার মনসুরাবাদের সেখানেও আন্দোলন হচ্ছে বলে জানতে পারি। এদিকে গুলির আওয়াজ বেশি আসায় আমরা কয়েকজন মিলে সেখান থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি করি।’
একদম ঝড়ের গুলি চালাচ্ছিল উল্লেখ করে মোমিনুল বলে, ‘আমি এক পাশ করে যাওয়াতে প্রথমে গুলি লাগেনি। তবে আমার সামনের একজনের গুলি লাগে। আমরা যেদিকে যাচ্ছিলাম সেখানে একটা বিদ্যুতের খুঁটি ছিল। সেটার পাশে দাঁড়ানোর কারণে ছোঁড়া গুলিগুলো আমার লাগেনি। কিন্তু সেখান থেকে দৌড়ে সরে যেতে গিয়েই আমি গুলিবিদ্ধ হই।’
তবে কারা গুলি ছুঁড়ছিল কিছু আঁচ করতে পারেনি ছোট্ট মোমিনুল।
মোমিনুল আরো বলেছে, ‘আহতাবস্থায় আমাকে সেখান থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা একটা অটোরিকশাতে তুলে দেয়। অটোরিকশা চালক আমাকে েএখানে (চমেক হাসপাতাল) নিয়ে আসে। চিকিৎসকরা আমাকে ভর্তি দেন। এখন আগের চেয়ে একটু ভালো আছি। প্রতিদিন একবার করে ড্রেসিং করছে। তখন একটু ব্যথা বেশি লাগে।’
পরিবারে টানাপোড়েন, অল্প বয়সেই হাতে রিকশার স্টিয়ারিং
বাবা-মা ও মোমিনুলসহ চার ভাই-বোনের পরিবার। এরমধ্যে বোন সবার বড়। আর তিন ভাইয়ের মধ্যে মোমিনুল সবার ছোট। বোনের বিয়ে হলেও বাকি তিন ভাই স্কুলের গণ্ডি পেরুয় নি। এরমধ্যে বড় ভাই এসএসসি আর মেজ ভাই ৭ম শ্রেণি পাস করেছে। পরিবারের সবার ছোট মোমিনুলের সেটিও হয়নি। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে দ্বিতীয় শ্রেণিতেই শেষ হয় তার পড়ালেখা।
পরিবারের তারা তিন ভাই এক বোন, বাবা-মা। বাবা শান্তিবাগ এলাকায় নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করেন। বড় দুই ভাইও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তিনজনের আয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না মোমিনুলের পরিবার। তাই মোমিনুল বাধ্য হয়ে নামে আয়ের খোঁজে। পরে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে রাস্তায় নামে। এরপর একটি এনজিও থেকে কিস্তির টাকায় নতুন অটোরিকশা কিনে। সারাদিন চালিয়ে যা আয় হয় তার থেকে কিস্তির টাকা ও পরিবারের খরচে সহযোগিতা করে।
ছোট ছেলের আয় বন্ধ, সংসারে সমস্যা
গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার পর থেকে মেডিকেলেই সময় কাটছে মোমিনুলের। তবে সে মেডিকেলে থাকায় সংসারে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। কারণ, তার আয়ের টাকায় সংসারের বেশিরভাগ খরচ জোগাতো। এছাড়া হাসপাতালে থাকায় তার কিস্তির টাকা পরিশোধ করতেও বেগ পেতে হচ্ছে।
ছেলের আয় বন্ধ হওয়ায় সংসারে সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়ে মোমিনুলের মা মোহসেনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে এতদিন হাসপাতালে পড়ে আছে। তার কারণে ঘর কিছুটা ভালোভাবে চলতো। এখন সে হাসপাতালে, বাড়তি যে টাকাটা আসতো; সেটাই বন্ধ। পাশাপাশি সে কিস্তির টাকায় অটোরিকশা কিনে। গাড়ি বন্ধ থাকলেও সেই কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া তার বাবা ও দুই ভাইয়ের যে আয় তাতেও সবকিছু সামলানো অনেক কষ্ট। তাই আমার ছোট ছেলেও রিকশা চালাতো।
সুস্থ হয়ে আবারও হাল ধরবে পরিবারের
এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেনি মোমিনুল। এর মধ্যেই পরিবারের চিন্তার ভাঁজ তার কপালে। তাই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই আবারও রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামার কথা জানিয়েছে মোমিনুল।
মোমিনুল বলেছে, ‘একটু সুস্থ লাগলেই রিকশা চালাবো। এভাবে বেশিদিন বসে থাকলে সংসারে আরো বেশি সমস্যা শুরু হবে। এছাড়া কিস্তির টাকাটাও তো পরিশোধ করতে হবে। যার কারণে বেশিদিন বসে থাকার সময় নেই।’
ছেলে বিজয়োল্লাসে, মা জানতেন না
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মোমিনুল বিজয় উল্লাসে গেলেও মোহসেনা বেগম (মোমিনুলের মা) সেটা জানতেন না। কারণ, বের হওয়ার সময় মোমিনুল জানিয়েছিল— বাইরে খেলতে যাচ্ছে। পরে এলাকার এক ছেলের কাছ থেকে জানতে পারেন মোমিনুল গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এরপর খবর নিয়ে ছুটে আসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে।
মোহসেনা বেগম বলেন, ‘ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমি জানতাম না সে আন্দোলনে গেছে। সে আমাকে বলেছিল বাইরে খেলতে যাচ্ছে। পরে খবর পাই সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখন খবর নিয়ে হাসপাতালে আসি।’
তিনি আরো বলেন, ‘হাসপাতালে তেমন কোনো টাকা খরচ হয়নি। খুব অল্প খরচ হয়েছে। বাকিসব হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়েছে।’
জেলা প্রশাসকের প্রতি অনুরোধ, বড় ছেলের একটা চাকরি দরকার
মোহসেনা বেগম বলেন, ‘ছেলেকে দেখতে এসেছিলেন জেলা প্রশাসক। তিনি আমাদের একটি যোগাযোগের জন্য কার্ড দিয়েছেন। টাকাও দিয়েছেন। তিনি আশ্বস্ত করেছেন পরিবারের কেউ একজনকে চাকরি দিবেন। তাই স্যারের প্রতি অনুরোধ থাকবে আমার তিন ছেলের মধ্যে যেকোনো একজনকে যেন কোথাও একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।’
এদিকে, গত ১৪ আগস্ট (বুধবার) বিকাল ৪টার দিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তাদের চিকিৎসার পাশাপাশি সার্বিক বিষয়ে চিকিৎসকদের সাথে কথা বলেন। এসময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের প্রত্যেককে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়। পাশাপাশি আহতদের পরিবারের অন্তত একজনকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।