চট্টগ্রাম

বিষণ্ণতা-উদ্বেগে ‘হাবুডুবু’ খাচ্ছে নার্সিং শিক্ষার্থীরা

দ্বিগুণ কাজের চাপ, আর্থিক সমস্যা, ব্যক্তিগত কারণ, একাডেমিক পরিবেশ, পরীক্ষা, স্ট্যাডি প্রজেক্ট, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এসাইনমেন্ট জমা দেয়া- এ সাত কারণে চরম মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন নার্সিং শিক্ষার্থীরা। নানামুখী চাপ তাদের মানসিক বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামের একটি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীদের উপর চালানো এক জরিপের তথ্য বলছে, ৭৩.৩% শিক্ষার্থী কখনও কখনও মানসিক চাপ অনুভব করেন। আর ২৩.৩% নিয়মিতভাবে চাপ অনুভব করেন। পাশাপাশি ৫৬.৭% শিক্ষার্থীর মধ্যে কখনও কখনও ভয় বা উদ্বেগের অনুভূতি কাজ করে, ৩০.০% অংশগ্রহণকারী এই ধরনের অনুভূতির নিয়মিত ভুক্তভোগী।

গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজের ১২০ জন নার্সিং শিক্ষার্থীর ওপর চালানো ওই জরিপে এসব তথ্য উঠে আসে। জরিপে স্বাভাবিক বিষণ্ণতার মানদণ্ডে ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য ওঠে আসে। আর ২০ শতাংশ নিজেদের আশংকাজনকহারে বিষণ্ণতায় ভুক্তভোগী এবং ২২ দশমিক ৫ শতাংশ অস্বাভাবিক বিষণ্ণতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

‘স্নাতক নার্সিং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণœতা এবং উদ্বেগের ব্যাপকতা’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজের লেকচারার এবং একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর তাজবীন ফারিহা। গবেষণায় শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ-বিষণœতা পরিমাপের জন্য হসপিটাল অ্যাংজাইটি এবং ডিপ্রেশন স্কেল ব্যবহার করা হয়।

গবেষণায় বলা হয়, ৩৫ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগের মাত্রা ছিল স্বাভাবিক, ৩০.৮ শতাংশের মধ্যে এর মাত্রা স্বাভাবিক সীমারেখার মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং ৩৪.২ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগের ব্যাপকতা অস্বাভাবিক মাত্রায়।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৮.৩ শতাংশ ছাত্রী ও ১১.৭ শতাংশ ছাত্র। তাদের গড় বয়স ২০.৫ বছর। এর মধ্যে ৩৪.২ শতাংশ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, ৩৭.৫ শতাংশ দ্বিতীয় বর্ষের ও ২৮.৩ শতাংশ তৃতীয় বর্ষের।

তাজবীন ফারিহা বলেন, মানসিক চাপ-উদ্বেগ নার্সিং শিক্ষার্থীদের নিজস্ব শান্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার শংকা থাকে। ফলে তাদের কর্মদক্ষতা হ্রাস পেতে পারে। নার্সিং পেশায় রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া একান্ত প্রয়োজন। অত্যধিক মানসিক চাপ এবং বিষণ্ণতা সেবার মানকে প্রভাবিত করতে পারে। একই সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতা, ভুল সিদ্ধান্তসহ চিকিৎসা ক্ষেত্রে ত্রুটির ঝুঁকি বাড়ায়। এই গবেষণামূলক প্রবন্ধটি আরও গবেষককে বিষণ্ণতা তীব্রতা শনাক্ত করতে সাহায্য করবে এবং উদ্বেগের মানসিক উপসর্গ নির্ণয় করে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম।

গবেষণার পরিসংখ্যানে বলা হয়, ৪১.৩ শতাংশ নার্সিং শিক্ষার্থী দ্বিতীয় বর্ষের মধ্যেই অস্বাভাবিক মাত্রায় উদ্বেগ চিহ্নিত করা হয়, যা অন্য দুইবর্ষের পর্যবেক্ষণ করা শতাংশকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলাফলগুলো ৩১.৭ শতাংশ ও ৩৫.১৩ শতাংশ। ২৩.৯ শতাংশ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা আশংকাজনক উদ্বেগ স্কোরগুলির একটি উচ্চতর ঘটনা প্রদর্শন করেছে, যা অন্য দুই বছরের রেকর্ড করা শতাংশকে ছাড়িয়ে গেছে ২১.৯০ শতাংশ এবং ১৮.৯১ শতাংশ। তাছাড়া, দ্বিতীয় বর্ষের মধ্যে ৩৯.১ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে অস্বাভাবিক মাত্রার বিষণ্ণতা দেখা যায়। যা প্রথম বর্ষে ৯.৭ শতাংশ এবং তৃতীয় বর্ষে ১৩.৫৫ শতাংশ।

চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মুসলিম উদ্দিন সবুজ বলেন, নার্সিং শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্যের উপর তদারকির বিষয়ে অবহেলা করার সুযোগ নেই। নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রমকে পাঠ্যক্রমের সঙ্গেও একীভূত করার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা যায়। কারণ নার্সদের উপর স্বাস্থ্যখাতের সফলতার অনেক কিছুই নির্ভর করে। গুণগত সেবা নিশ্চিতে ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মানসিক সুস্থতার উপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ল্যানসেট কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিশ্বের প্রতিটি দেশে মানসিক ব্যাধি বাড়ছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি ১৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এই আর্থিক ক্ষতির একমাত্র প্রত্যক্ষ কারণ মানসিক অসুস্থতা এবং এর ফলস্বরূপ কর্মদক্ষতা হারানো। প্রতি বছর মানসিক অসুস্থতার কারণে আনুমানিক ১২০০ কোটি সমপরিমাণ কর্মদিবস নষ্ট হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d