বিষাক্ত শিশুখাদ্যে বাজার সয়লাব
শিশুদের আকৃষ্ট করতে স্কুলের বাইরেই নানা বাহারি খাবার। ফেরিওয়ালা থেকে দোকান সব জায়গায় নানা রঙের চিপস, চকোলেট। অভিভাবকরাও জানেন না, তারা শিশুদের কী খাওয়াচ্ছেন। শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশু বিশেষজ্ঞরা জানান, এখন শিশুদের মধ্যে কিডনি, লিভার ও স্নায়ুরোগ ব্যাপক মাত্রায় বাড়ছে। এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেল-জরিমানা ও কারখানা সিলগালা করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না ভেজাল খাদ্যপণ্য প্রস্তুতের বেআইনি কাজ। নামি ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজার সয়লাব নকল এবং মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর শিশুখাদ্যে। পরিচিত দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের চকলেট, জুসের মতো শিশুপ্রিয় কমপক্ষে ২০টি খাদ্য নকল করে বাজারে ছাড়া হয়েছে। এসব নকল ও ভেজাল পণ্যের মোড়ক দেখে কোনটা আসল, কোনটা নকল- তা বোঝার উপায় নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ভেজাল খাবারের কারণে শিশুর পেটের পীড়া, চর্মরোগসহ গলার প্রদাহ হয়। তাছাড়া ঝুঁকি বাড়ছে শিশুর কিডনি ও লিভার অকেজো হয়ে পড়ার। চিকিৎসকরা এ-ও বলেছেন শিশুর ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে এসব খাবারে।
সূত্র মতে, খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভেজালবিরোধী অভিযানও চালিয়ে আসছে। কিন্তু এসব ভেজাল পণ্যের লাগাম টানা যাচ্ছে না সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশের কারণে।
গত বছরের ৮ মে ডেমরার ‘আল-ফালাক ফুড অ্যান্ড বেভারেজ’ কারখানায় অভিযান চালিয়ে ২৮ রকমের নকল জুস ও শিশুখাদ্য উদ্ধার করে বিএসটিআই। অভিযান প্রসঙ্গে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক জিশান আহমেদ তালুকদার বলেছিলেন, পণ্যের মধ্যে বিএসটিআইয়ের লোগো থাকলেই তা নকল নয়, এমনটি মনে করা যাবে না। কারণ, যেকোনো সময় তারা প্রিন্ট করে লোগো ব্যবহার করছে। কাজেই লোগো আছে বলেই বিএসটিআই অনুমোদিত মনে করা যাবে না।
অভিযান চালানোর পরও কীভাবে এসব কারখানা চলছে জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের অতিরিক্ত পরিচালক রেজাউল হক বলেন, আসলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ওঁৎ পেতে থাকে। আমাদের অভিযানে সিলগালা করার পর অন্য স্থানে গিয়ে আবার চালু করে। তিনি বলেন, আমাদের সন্ধানে এলেই ফের সেই কারখানাগুলোয় অভিযান পরিচালনা করি। যদি আপনাদের সন্ধানে এমন খোঁজ থাকে আমাদের জানাবেন। আসলে সবাই মিলেই এই দুষ্ট চক্রকে রোধ করতে হবে।
বিভিন্ন কারখানায় অভিযানে থাকা র্যাবের সাবেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া নামমাত্র ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে এসব কারখানা।
শিশু খাদ্য বা খাদ্যে ভেজাল কীভাবে রোধ করা যায় সে সম্পর্কে কথা হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রথমত এসব খাবারের কাঁচামাল আসে বিদেশ থেকে। এ বিষয়ে কাস্টমসকে চেক দিতেই হবে। এ ছাড়া নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আছে, বিএসটিআই আছে- প্রত্যকের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। ভোক্তা তো অভিযোগ পেলেই অভিযান চালায়। এক কথায় সবার সমন্বয়ে খাদ্যে ভেজাল রোধ করতে হবে।
নকল বা ভেজাল শিশুখাদ্যের ঝুঁকি নিয়ে কথা হয়েছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, শিশুদের খাওয়ানো হয় পুষ্টি বৃদ্ধি, শরীরের ক্ষয়পূরণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। ভেজাল খাদ্য খেলে এগুলো বিঘ্নিত হয়।
ভেজাল খাদ্য রোধে সমন্বিত উদ্যোগের গুরুত্ব তুলে ধরে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এগুলো যারা দেখেন তারা কয়েটি জায়গায় বিভক্ত। একটি হলো বিএসটিআই। অনেক সময় দেখা গেছে বিএসটিআই মান নির্ধারণ করে অনুমতি দিয়েছে। সেই মান ঠিক থাকল কি না, পর্যবেক্ষণ হয় কি না- আমরা জানতে পারি না। কিন্তু হঠাৎ করে অভিযানে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে দেখা যায় এগুলোর মান ঠিক নেই।
ভেজাল খাদ্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া বলেন, শিশুদের পছন্দের যেসব ব্র্যান্ডের নকল পণ্য পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে আছে ভারতের ডেইরি মিল্ক, কিটক্যাট, কিন্ডার জয়, বাংলাদেশের প্রাণ ডেইরির জুস, আইস ললি, অরেঞ্জ ড্রিংকস, লিচি ড্রিংকস, মিল্ক ক্যান্ডি, ম্যাংগো ক্যান্ডিসহ বিভিন্ন ধরনের জুস, চিপস ও তেঁতুলের আচার। নামি-দামি ব্র্যান্ডের এসব পণ্যের কোনটা আসল কোনটা নকল তা বোঝা খুব মুশকিল।